ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশি আনন্দ।

Wednesday, July 8, 2020

আমার একটা গল্প ছিল

valobashar golpo, love story, ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প
.
আমি যে বাকি আট-দশটা স্বাভাবিক মেয়েদের মতো নই সেটা বুঝেছিলাম অনেক ছোটবেলাতেই। সেটা বুঝার আগ অবধি ভাবতাম পুরো পৃথিবীটা হয়তো আমার জানা মতোই। তবে আসলে এমনটা ছিল না। মা-বাবার দু'একটা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ছাড়া তখন কিছুই বুঝতাম না৷ আসলে বুঝবো কী করে! তাদের কথা তো আমার বুঝার জন্য নিয়ম মাফিক ছিলই না।
চতুর্থ শ্রেণীতে থাকতে হঠাৎই আমাদের বিদ্যালয়ের সব শ্রেণীকক্ষে ফিঙ্গার স্পেলিং আর সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের বিভিন্ন প্রাথমিক ধারণার চিত্র আঁকা হয়। এরপর থেকেই শিক্ষকরা সহ সহপাঠীরা অনেকেই আমার সাথে টুকটাক স্বাভাবিক কথা গুলো বলার চেষ্টা করতো। এই ধরেন, কী খেয়েছি, কেমন আছি, এক, দুই, তিন এসব।
এক সময় বইয়ের মাধ্যমেই বুঝতে পারলাম আমি সবার থেকে ঠিক কতটা আলাদা! আমি না শুনতে পারি আর না বলতে৷ কষ্ট বেশি হতো তখন, যখন কাউকেই কিচ্ছু বুঝাতে পারতাম না৷ নিজের কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি না বুঝানোর কষ্ট হয়তো পৃথিবীর সবচে বড় কষ্ট গুলোর অন্যতম! 
এজন্য যেমন অনেকের ভালোবাসা, মায়ার পাত্র হয়েছি ঠিক তেমনি ওই তাদের কাছেই আবার অতিরিক্ত বোঝা, অবহেলা আর মজার বস্তু ও হয়েছি। যেন সব মিলিয়ে আমার জীবনটাই ছিল বাক্যহীন!
. বাক প্রতিবন্ধী হলেও ছাত্রী হিসেবে অনেক ভাল ছিলাম আমি। তাই পরিবার খুব একটা স্বচ্ছল না হলেও বিনা অর্থায়নে পড়ার সুযোগ পেতাম। জেএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে পাশের এলাকারাই একটা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম৷ আর আমার অস্বাভাবিক জীবনের অস্বাভাবিক সময়েরও শুরু হতে শুরু করল!
. বয়স খুব বেশি না হলেও আমি শারীরিক দিক থেকে অনেক স্বাস্থ্যবান ছিলাম। ফলে রাস্তাঘাট এমনকি এলাকাতেও ছোট-বড়, বুড়োরা প্রায় অনেকেই অন্য নজরে যে তাকাতো সেটাও খুব ভাল করেই বুঝতাম৷ তবে বাবা-মায়ের পর যার স্থান সবচে উপরে সেই শিক্ষক নামক মানুষরূপী শুয়োরের সাথে দেখা হয়েছিল নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই। আমাদের রসায়ন ক্লাস নিতেন রতন স্যার। তিনি কেমন ক্লাস নিতেন জানি না তবে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরাই দেখতাম বুঝতো না৷ স্যার কোনো মেয়ে না বুঝলেই তার পাশে গিয়ে বসে খাতায় বুঝিয়ে দিতেন। খুব ভালোই ছিল এতদূর৷ তবে একদিন একটা বিক্রিয়া বুঝানোর জন্য স্যারকে বলায় স্যার আমার পাশে বসে বিক্রিয়াটা খাতায় তুলে দিলেন৷ আর যাওয়ার সময় আমার পিঠে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলেন৷ খুব একটা খারাপ না লাগলেও গায়ে হাত দেয়াটা ভাল লেগেছিল না সেদিন৷ তবে এরপর থেকে লক্ষ্য করতাম প্রায় মেয়েদেরই বুঝানোর নাম করে পাশে বসে গায়ে হাত দেয়া, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়াটা। পরে বুঝলাম এসবই স্যারের জঘন্যতম চরিত্রেরই নমুনা মাত্র।
লজ্জায় আর ভয়ে অনেক মেয়েই দেখতাম কুঁচকে যেত তবে কেউ একটাও কথা বলতো না৷ এমনকি শিক্ষক হওয়ায় আমিও সব সহ্য করে যেতাম৷ তবে একদিন সব কিছু সহ্যের বাইরে চলে গেল।
সেদিন টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসে বসে বসে আর্ট করছিলাম৷ সবাই বাইরে খেলাধূলায় মেতে ছিল৷ হঠাৎই রতন স্যার রুমে ঢুকলো হাসিমুখে। আমাকে দেখে পাশে বসতে বসতে হয়তো বললেন,
কি করিস রে? 
আমি মুচকি হাসার অভিনয় করে স্যারকে আর্ট করছি সেটা বুঝালাম৷ স্যার আর্ট দেখলেন। হাসি মুখে ফিঙ্গার স্পেলিং করে বললেন, খুব সুন্দর। 
পুরো ক্লাস তখন ফাঁকা। হয়তো এই সুযোগটাই স্যার নিতে চাইছিলেন৷ খাতাটা বেঞ্চে রেখে আমার কাঁধটা ধরে তিনি জড়িয়ে ধরার মতো করে বুকের সাথে লাগিয়ে ধরার চেষ্টা করছিলেন। ভয়ে আর লজ্জায় তখন আমার মনে হচ্ছিল বাষ্প হয়ে কোথাও মিলিয়ে যাই৷ তবে কিছুই পারছিলাম না৷ হাত-পা একদম অবশ হয়ে আসছিল। তবুও খুব কষ্ট করে একটা ঝাঁকি দিতেই স্যার ছেড়ে দিয়ে মুচকি হেসে চলে গেলেন। 
খুব বেশি ঘৃণা লাগছিল স্যারের উপর। বইয়ে পড়া রচনার মতো আদর্শ শিক্ষক আসলে ক'জন হয়?
তবে ভয়ে হোক বা ঘৃণায় হোক এরপর থেকে আর স্কুলে যাই নি একদিনও। আর আস্তে আস্তে পড়াশোনারও ইতি টেনে গেল।
.পড়াশোনা না করলেও টুকটাক অনেক কাজই পারতাম আমি৷ ঘরে সেলাই মেশিনে জামাকাপড় বানানোর কাজ আমার চাচির কাছে খুব ছোটবেলাতেই রপ্ত করে নিয়েছিলাম। তাই পড়াশোনা বাদ দিলেও কখনোই বোঝা হয়ে থাকতে হয় নি। বরং আমি যা জামাকাপড় বানিয়ে আয় করতাম সেটা দিয়ে আমার পরিবারেরও অনেকটা সাহায্য হয়ে যেত।
. চেহারা ভাল হওয়ায় আর সংসারের সব কাজই ভাল পারায় প্রায়ই বিয়ে আসতো আমার৷ তবে বাক প্রতিবন্ধী হওয়ায় সবাই যে বাবার কাছে যৌতুক চাইতো সেটাও বুঝতাম৷ কারণ হাসিমুখে আমাকে পছন্দ হলেও বিয়ে আর হতো না৷
এভাবেই চলতে চলতে একদিন হুট করেই যেন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল৷ চাচাতো বোন, ভাবিরা এসে শুধু সুন্দর করে সাজিয়ে বসিয়ে দিয়ে গেল। বিয়ের ঘণ্টা দুয়েক আগে শুধু জানলাম বিয়েটা হচ্ছে সালাউদ্দিনের সাথে৷ তাকে আমি চিনতাম৷ তার বাড়ি আমাদের এলাকাতেই। পড়াশোনা খুব বেশি না করলেও উনি ছিলেন কয়েক এলাকার মাঝে সবচে ভাল ইলেকট্রিশিয়ান৷ দেখতে আমার থেকেও বেশি ফর্সা আর সুন্দর হলেও উনিও আমার মতোই বাক প্রতিবন্ধী ছিলেন৷
.সন্ধ্যার একটু পরপরই বিয়েটা হয়ে গেছিল আমার। গুটিকয়েক মানুষের আয়োজনেই হয়েছিল কেমন ঘোরের মাঝেই এসব হয়ে গেল বলে ভাল লাগছিল না আমার। তবে সেই খারাপ লাগাটা খুব বেশি সময় ছিল না।
বড্ড অস্বস্তি নিয়ে বাসর ঘরে বসে ছিলাম৷ উনি কিছু সময় পর ঘরে ঢুকলেন৷ ওনার আসা দেখে ভয়ভয় লাগলেও একটু পরই পাশে বসে বললেন,
-- কেমন সব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল তাই না? 
-- জ্বি। 
-- এইযে দেখেন সব কত স্বাভাবিক ছিল সকাল বেলাতেও৷ আমি কাজ করতে গেলাম আর বিকেলে আব্বা কোনো রকমে জানিয়ে দিলো আপনার সাথে আমার বিয়ে৷ লজ্জা লাগছিল খুব। কিন্তু একটা বিষয় খুব ভাল হয়েছে জানেন তো? 
-- কোন বিষয়টা?
-- এইযে আমিও কথা বলতে পারি না আর আপনিও না৷ আমরা দু'জন বাকিদের থেকে একদম আলাদা৷ আমরা এতদিন কতটা কষ্টে ছিলাম তা কি কেউ জানতো? সবার টিটকারি করা, মজা নেয়া আর কথা বলতে, শুনতে না পারার কষ্ট তারা কী করে বুঝবে৷ আমাদের অনুভূতি বুঝার মতো কেউ নেই।
আমিও ভেবে দেখলাম আসলেই তো!
সে আবার বলল,
-- ধরেন আপনার সাথে যদি কথা বলতে পারা ছেলের বিয়ে হতো তাহলে আপনি না পারতেন তাকে কিছু বুঝাতে আর না সে আপনাকে বুঝতো৷ সংসার জীবনে বড্ড সমস্যা হতো। 
কিন্তু দেখেন আমরা দু'জন কত বকবক করছি, হিহিহি। 
আচ্ছা আমি আবার বেশিই বকবক করছি না তো? করলে করলাম৷ আসলে এতটা জীবন ভাবছিলাম জীবনেও আমি কাউকে মন খুলে কিছু বুঝাতে পারবো না তবে কে জানতো আল্লাহ আমার জন্য এত ভাল কিছু রাখছে। এখন থেকে আমরা দু'জন আমাদের অব্যক্ত সব কথাই একে অপরকে বলতে পারবো, হিহিহি।
মানুষটা পাগল কিসিমে’র হলেও অল্প সময়েই আমার মনটা জয় করে নিয়েছিল৷ আসলেই তার কথা ঠিক৷ এইযে সে খুব বেশি বকবক করছিল সেটা আমিও চাইছিলাম৷ তবে লজ্জায় বলতে পারি নি আমি । তবুও সে রাতে প্রায় অনেক রাত অবধিই আমরা গল্প করেছিলাম৷
.বাকি সময়টা ঠিক গল্পের মতোই সুন্দর। সালাউদ্দিনের মা-বাবা আর ও মিলে ছোট্ট সংসার। সেই সংসারে আমি এলাম। ওর বাবা-মা যে আমাকে কতটা আদর করতো তা বলে বুঝাতে পারবো না। আর সালাউদ্দিনের কথা নাই-বা বলি। না বলা কথা গুলোর খৈ ফুটাতে শুরু করেছিল সে। দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতোই কাটতে শুরু করেছিল আমার৷ তবে হঠাৎ সেই স্বপ্ন যেন আর স্বপ্ন রইলো না! বাস্তব যখন খুব বেশি সুন্দর হয় তখন আর স্বপ্ন ভালো লাগে না। আমারও হলে ঠিক তাই।
আমার ভেতর আমি আরও একটা প্রাণের অনুভব করতে শুরু করলাম৷ একদিন রাতে সালাউদ্দিনকে কথাটা জানাতেই ও খুশিতে আমাকে অনেকটা সময় জড়িয়ে ধরে রেখেছিল । তারপর বলেছিল,
-- আচ্ছা যদি ছেলে হয় তো কী নাম রাখবো?
-- আমি তো জানি না।
-- মেয়ে হলে কী রাখবো?
-- তাও তো জানি না, তুমিই বলো। 
-- আমিও তো জানি না, হাহাহা৷
-- আচ্ছা, বাবু যদি আমাদের মতোই কথা বলতে না পারে তো? মন খারাপ করে উনি বলেছিলেন। 
তবে বলেছিলাম,
না পারলেই বা কী সমস্যা, আমরা দু'জন আছি না?
বাবু আমাদের মতো হলে আরও ভাল হবে। আমরা তিনজনই এক হবো৷ 
সালাউদ্দিন খুব খুশিই হয়েছিল৷ তবে ভয় লাগছিল কিছুটা আমার৷ আমি চাইছিলাম যেন বাবুটা স্বাভাবিক হয়৷ কারণ পুরো পৃথিবীটা আমাদের মতো অনুভব করতে পারবে না ও সেটা কেমন হয়! আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী মানেই শুধু অবহেলার পাত্র আর পরিবারের জন্য বোঝা৷
নাহ, তা হয় নি৷ পরের গল্প তার চেয়েও সুন্দর ছিল। আমার মেয়ে টা নাকি আধো আধো স্বরে আব বা, ম্যা ম্যা বলে৷ 
আমার শ্বাশুড়ি মা বলেছিলেন৷
বইতে পড়েছিলাম 'মা' ডাক শুনা পৃথিবীর সবচে সুন্দর মুহূর্তের একটা। তবে যদিও আমার ভাগ্যে তা নেই তবুও আমি একজন সুস্থ আর স্বাভাবিক বাচ্চার মা হতে পেরেছিলাম এটাই অনেক৷ ওহ, হ্যাঁ, আমাদের মেয়ের নাম রেখেছিলাম 'কথা'৷ না বলা বাবা মায়ের একমাত্র আদুরে কন্যা আমাদের কথা।
আমি সালাউদ্দিনকে যত দেখেছি ততই অবাক হয়েছি৷ একটা মানুষ নতুন নতুন ভাবে কী করে এতটা ভালোবাসতে পারে তাকে না দেখলে বুঝতামই না৷ আনাদের সংসারের মতো হাসিখুশি সংসার আসলেই আর হয় কি না জানি না৷ 
মাঝে মাঝে তাই মনে হতো,
আল্লাহ আমাকে এভাবে না পাঠালে হয়তো কখনোই এই বিশাল মনের মানুষটার ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য হতো না৷
সব মিলিয়ে এখন আমি আলহামদুলিল্লাহ অনেক সুখে আছি।

1 comment:

comment

Contact Us

Name

Email *

Message *