স্বামীর টাকার ইনকামের উপর নির্ভর করে বাড়ির বউয়ের সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেমন আচরণ করবে।রায়হানের সাথে যখন আমার বিয়ে হয় তখন রায়হান একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বড় পদে জব করতো। যেহেতু, আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছিলো সেহেতু; রায়হান প্রতি সপ্তাহে বাড়ি আসতো। বৃহস্পতিবার অফিস শেষে সন্ধ্যার দিকে মহাখালী থেকে বাসে উঠতো আর রাত ১০-১১টার দিকে ময়মনসিংহ এসে পৌঁছাতো। একদিন রায়হানকে আমি মুখফোটে বলেছিলাম,
--তুমি প্রতি সপ্তাহে বাড়ি না এসে আমাকেই তো তোমার কাছে নিয়ে রাখতে পারো।
আমার কথা শুনে রায়হান মুচকি হেঁসে বলেছিলো,
-" আমি যে শুধু তোমার জন্য প্রতি সপ্তাহে বাড়ি আসি সেটা তোমায় কে বললো? বাসায় বাবা-মা আছে ভাই-বোন আছে আমি তাদেরকেও দেখতে আসি। তোমাকে যদি ঢাকায় নিয়ে যায় তবুও কিন্তু প্রতি সপ্তাহে আমি বাড়ি আসবো"
রায়হানের কথা শুনে আমি নিজের কাছে নিজে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। আবার ভয়ও পেয়েছিলাম রায়হান যদি আমার কথায় ভুল বুঝে সেটা নিয়ে।
আমি রায়হানের হাত ধরে বলেছিলাম,
--তুমি আমায় ভুল বুঝো না। আসলে তুমি প্রতি সপ্তাহে এতোটা পথ জার্নি করে আসো তো তাই আমার খুব চিন্তা হয়। মনে নানা রকম ভয় কাজ করে...
রায়হান কখনো শুধু আমার জন্য কোন কিছু কিনে আনে নি। একদিন কথার কথা রায়হানকে বলেছিলাম, আমার একটা নীল শাড়ি লাগবে।
রায়হান পরের সপ্তাহে যখন বাড়িতে আসে তখন দুইটা নীল শাড়ি আনে। একটা আমার জন্য আরেকটা তার ছোট বোনের জন্য। ঈদ আসলে আমার আমার মা-বাবার জন্য রায়হান যে শাড়ি পাঞ্জাবি কিনতো সেইম শাড়ি পাঞ্জাবি তার বাবা-মা'র জন্য কিনতো। আমার ছোট ভাইয়ের জন্য যে ডিজাইনের শার্ট-প্যান্ট কিনতো সেইম শার্ট-প্যান্ট ওর ছোট ভাইকেও কিনে দিতো। আমায় যা কিনে দিতো সেইম জিনিস তার ছোট বোনকে কিনে দিতো।
একবার রায়হানের সাথে শপিং করার সময় আমার একটা জামা খুবই পছন্দ হয়েছিলো। আমি যখন এটা নিতে যাবো তখন রায়হান দোকানদারকে বলেছিলো, সেইম ডিজাইনের সেইম রঙের আরেকটা জামা দিতে। দোকানদার যখন বললো এটা শুধু এক পিস আছে । রায়হান তখন সে জামাটা নিতে আমায় না করেছিলো
আমি আবাক হয়ে রায়হানকে প্রশ্ন করেছিলাম,
-- তুমি এইভাবে কেনাকাটা করো কেন? আলাদা আলাদা ডিজাইনের জিনিস কিনলে কি হয়?
রায়হান হেসে উত্তর দিয়েছিলো,
-" সেইম জিনিস কেনাকাটা করি এজন্যই যাতে আমার পরিবারের কোন সদস্য তোমায় কখনো কথা শুনাতে না পারে। আজ যদি আমার বাবা-মা, ভাই-বোনের জন্য একরকম জিনিস কিনি আর তোমার বাবা-মা, ভাইয়ের জন্য অন্য রকম জিনিস কিনি তাহলে আমার পরিবারের লোক ভাবতেই পারে তোমার বাবা-মাকে দেওয়া কাপড়টা দামী আর তাদের দেওয়া কাপড়টা কম দামী।"
রায়হান একদিকে যেমন ওর বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতি কর্তব্য পালন করতো তেমনি অন্যদিকে আমার প্রতিও খুব দায়িত্বশীল ছিলো। আর আমি নিজেও শ্বশুর-শ্বাশুড়ি
---
-------
সময়ের পরিক্রমায় অনেককিছু বদলে যায়। রায়হান যে কোম্পানিতে জব করতো সেটা হুট কিছু সমস্যা জনিত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। রায়হান তখন বেকার বাসাতেই থাকে।আর ঐদিকে আমার দেবরের খুব ভালো একটা চাকরি হয়। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম বাড়ির প্রতিটা সদস্য আস্তে আস্তে আমার ছোট দেবরের কথা বেশি মূল্যায়ন করতে শুরু করলো। আর আমার স্বামী কিছু বললে সেটা ওরা কানেই নিতো না। রায়হান যদি কোন কাজের সিদ্ধান্ত নিজ থেকে নিতে চাইতো শ্বশুর শ্বাশুড়ি বাঁধা দিয়ে বলতো, " আগে রাকিবকে( আমার দেবর) জিজ্ঞেস করে নে"
ননদীর বিয়ে ঠিক হয়েছে সেটা নিয়ে আমরা সবাই আলোচনায় বসলাম। কত খরচ হতে পারে, ছেলেকে উপহার সামগ্রী কি কি দিবে, ননদীর জন্য কেমন ধরনের গহনা বানাবে সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো। আমার শ্বশুর আমার স্বামীকে বললো,
~বোনতো শুধু একা রাকিবের না। এটা তো তোরও বোন হয়৷ তাই যা খরচ হবে তোরা দুইভাই সমান সমান দিস।
আমার স্বামী তখন অসহায়ের মতো বসে মাথা নিচু করে বললো,
- বাবা, আমার বর্তমান অবস্থাটা তো জানোই। আমি কিভাবে এতো টাকা দিবো? আমি যতটুকু পারি এখন দিচ্ছি বাকীটা রাকিব ব্যবস্থা করুক। আমি নাহয় পরে শোধ করে দিবো
আমার দেবর তখন বললো,
-" আমি না হয় সব খরচ দিলাম কিন্তু বাসার সামনে যে ৪ শতাংশ জমি ভাইয়ের নামে আছে সেটা ভাই আমার নামে লিখে দিক।"
দেবরের কথাতে যতখানি না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি যখন দেখলাম আমার শ্বাশুর-শ্বাশুড়
নিজের স্বামীর এমন অসহায়ত্ব চেহারাটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। নিজের রুমে ঢুকে আলমারি থেকে সমস্ত গহনা বের করে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি
-" এইখানে যত গহনা আছে তা দিয়ে নিশ্চয়ই অর্ধেক খরচ বহন করা যাবে। তবুও আমি এইজমি আমার স্বামীকে অন্য কারো নামে লিখে দিতে দিবো না। "
আমার কথা শুনে রায়হান আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
-" এই গহনা নিয়ে নিজ রুমে যাও "
দেবরের দিকে তাকিয়ে বললাম,
--লজ্জা করে না বড় ভাইয়ের দূর্বলতার সুযোগ নিতে?
রায়হান তখন আমার গালে একটা থাপ্পড় মারে। আমি গালে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-- যে বাবা-মা, ভাইয়ের প্রতি দায়িত্বের এতটুকু অবহেলা করো নি সেই বাবা-মা, ভাইয়ের থেকে প্রতিদান স্বরূপ কি পেলে একটা বার ভেবে দেখো!
এই কথা বলে নিজ রুমে চলে আসি। জানালার গ্রিল ধরে যখন বাহিরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন খেলায় করি রায়হান পিছন থেকে আমায় খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। বুঝতে পারছিলাম রায়হান খুব কান্না করছে কিন্তু আমি একটারও ওর কান্না থামাতে চেষ্টা করি নি। কাঁদুক, কাঁদলে যদি ভিতরের যন্ত্রণাটা একটু কমে...
|
|
দুই ভাইয়ের মাঝে যখন সবকিছু ভাগাভাগি হয় তখন রায়হান বলেছিলো,
-"মা-বাবা আমার সাথে থাকুক"
আমার শ্বশুর বলেছিলো,
~" নারে, আমরা না হয় রাকিবের কাছেই থাকি।প্রতিমাসে আমাদের যে ঔষধের খরচ সেটা তুই চালাতে পারবি না। এমনিতেই তোর অবস্থা খারাপ"
রায়হান চোখের পানি কোন রকম ভাবে আটকে রেখে আমার শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
-" মা, আমার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। তুমি না হয় অন্তত আমাদের সাথে থাকো৷"
তখন আমার আদরের ননদী তার বড় ভাইকে বললো,
~"ভাইয়া তুমি তো দেখছি খুব স্বার্থপর। নিজের বউয়ের সেবার জন্য নিজের মাকে চাকরানী হিসাবে রাখতে চাইছো।"
আদরের ছোট বোনের থেকে এই কথা শুনার পর রায়হান চুপ হয়ে গিয়েছিলো আর অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছিলাম আমি...
রায়হান যেদিন আমায় বাবার বাড়ি দিয়ে আসে সেদিন ও বাসার ভিতর ঢুকে নি। আমাকে গেইটের সামনে দিয়েই চলে গিয়েছিলো। আর যাওয়ার আগে বলেছিলো,
-" যতদিন চাকরি না হবে ততদিন সন্তানের মুখ দেখতেও আসবো না।"
রায়হান চলে যাবার পর এমন কোন রাত নেই যে আমার বালিশ ভিজে নি। জায়নামাজে বসে কত যে চোখের জল ফেলেছি সেটা শুধু আমি আর আমার আল্লাহ জানে...
---
-----
৩বছর পর....
বিকালের দিকে আমার ছেলে রায়ানকে নিয়ে আমি যখন ছাদে খেলছিলাম তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রায়হান হঠাৎ বললো,
-"আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মা হয়তো আমাকেও নিয়ে এইভাবে খেলতো"
রায়হানের কথা শুনে আমি কিছু বলি নি। আমার চুপ থাকা দেখে রায়হান আমতা-আমতা করে আমায় বললো,
-"সন্তানের কখনোই উচিত না বাবা মায়ের প্রতি রাগ করে থাকা। বাবা মা কত কষ্ট করে সন্তান.."
রায়হানকে আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
-- সোজাসাপ্টা বলো কি বলতে চাও....
রায়হান মাথা নিচু করে বললো,
- "আমি চাই মা-বাবা আমাদের সাথে থাকুক। আসলে রাকিবের এইখানে বাবা-মা ভালো নেই। শুনেছি রাকিবের বউ বাবা-মা'র সাথে খুব বাজে ব্যবহার করে "
আমি হেসে বললাম,
-- তোমার বাবা মাকে তোমার কাছে রাখতে চাও এতে আমায় জিজ্ঞেস করার কি আছে? তুমি যে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা তোমার মা-বাবাকে পাঠাও তখন তো আমায় জিজ্ঞেস করো না।তাহলে এখন কেন জিজ্ঞেস করছো?
রায়হান অবাক হয়ে বললো,
-" তুমি জানতে আমি বাবা মাকে টাকা পাঠাই? "
-- আমি যখন জানতে পেরেছি তুমি তোমার বাবা মাকে আমার অজান্তে টাকা দাও তখন আমি একটুও কষ্ট পাই নি। বরং তোমার প্রতি আমার সম্মানটা বেড়ে গিয়েছিলো। আমার খুব গর্ব হতো এটা ভেবে বাবা মা তোমার প্রতি অন্যায় বিচার করলেও তুমি সন্তান হয়ে বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য ঠিক মতই পালন করছিলে।
আমি রায়ানকে কোলে নিয়ে যখন নিচে নামবো তখন রায়হান পিছন থেকে আমার হাতটা যখন ধরলো তখন আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
--তুমি চিন্তা করো না। এইখানে তোমার বাবা মায়ের বিন্দু পরিমাণ অসম্মান হবে না.
লিখা: আবুল_বাশার_পিয়া
No comments:
Post a Comment
comment