রোদেলা ছিল কলেজের সবচেয়ে রাগি মেয়ে। কেউ একটু কিছু বললেই চোখ রাঙানো, খোঁচা মারা, দরজা ধুম করে বন্ধ করে চলে যাওয়ার নামই যেন রোদেলা।
কিন্তু ওর রাগের পেছনে যে একটা কষ্ট আছে, সেটা খুব কম মানুষই জানত।
ছোটবেলায় মা-বাবার ডিভোর্স, তারপর মায়ের কঠোর শাসনে বড় হওয়া—সবকিছু মিলিয়ে রোদেলা কেমন যেন একটু ঠান্ডা আর কড়া মনের মানুষ হয়ে গিয়েছিল। ওর চোখে ছেলে মানেই বিপদ, আর প্রেম? "ওসব ফালতু সিনেমার জিনিস"—এই ছিল ওর ভাবনা।
অন্যদিকে অভ্র ছিল একেবারে উল্টো। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, আর সবাইকে ভালো রাখার জন্য ও যেন নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। সে ছিল নতুন ছাত্র, সদ্য ভর্তি হয়েছে রোদেলার ক্লাসে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলে, শুধু রোদেলার সঙ্গেই যেন তার বিশেষ আগ্রহ।
প্রথমদিন রোদেলার পাশে বসতেই সে বলেছিল,
"তুমি এই কলেজের অ্যাটেনডেন্স অফিসার না? সবাইকে এমন দৃষ্টি দিয়ে কেন দেখো?"
রোদেলা ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল,
"তুমি আমার পাশে বসার সাহস কোথা থেকে পাও?"
অভ্র হেসে বলেছিল, "তোমার চোখ দুটো ভয়ংকর সুন্দর। ভয় পাই, কিন্তু সরতেও পারি না।"
সেদিন অভ্র একটা খোঁচা খেল, কিন্তু ও থামেনি।
দিন দিন অভ্র নানা অজুহাতে রোদেলার আশেপাশে থাকতে লাগল। লাইব্রেরিতে ওর পেছনে বসা, ক্যান্টিনে ওর পছন্দের খাবার রাখা, ক্লাসে চুপচাপ হুম করে বসে থাকা—সব যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল।
রোদেলা বুঝত এসব, কিন্তু কিছু বলত না। কখনো বিরক্ত হত, কখনো ঠান্ডা গলায় বলে দিত, "আমি এসব পছন্দ করি না।"
তবুও অভ্র প্রতিদিন নতুন কোনো হাসি নিয়ে হাজির হত।
একদিন ক্লাসের সবাই গিয়েছিল গ্রুপ আউটিং-এ। অভ্র তখন সাহস করে রোদেলাকে বলল,
"তুমি কেন একা থাকো সবসময়? কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পাও নাকি?"
রোদেলা একটু থেমে বলল,
"কারো ওপর ভরসা করলে যদি সে ভেঙে দেয়, তখন কষ্টটা তুমি বুঝবে?"
অভ্র একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
"আমি বুঝি না বলছো? তাহলে একটা সুযোগ দাও, দেখো বুঝতে পারি কিনা।"
সেই প্রথমবার, রোদেলা কাঁপা গলায় বলেছিল,
"আমি ভয় পাই। ভয় পাই আবার বিশ্বাস করতে, আবার ভালোবাসতে।"
অভ্র বলেছিল,
"তুমি ভয় পাও, আমি তো আছি তোমার পাশে। আমার বিশ্বাসে তুমি যদি ধীরে ধীরে ভরসা করো, আমি জানি, একদিন তুমি হাসবে—রাগ না করে, ভালোবেসে।"
এরপর সম্পর্কটা বদলাতে শুরু করল। রোদেলা ধীরে ধীরে খুলে গেল, একটু হাসি, একটু কম রাগ, আর অভ্রকে একটু বেশি সময় দেওয়া।
তবে ওর রাগ কমে যায়নি। অভ্র মাঝে মাঝে মজা করে বলত,
"তোমার রাগটা রাখো, তবে সেটা শুধু আমার জন্য রেখো।"
রোদেলা গম্ভীর মুখ করে বলত, "তুমি একটা বিরক্তিকর লোক!"
আর অভ্র হাসত, “আর তুমিই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ঝড়।”
একদিন হঠাৎ করে রোদেলার পুরোনো এক বন্ধু কলেজে আসে। সে ছিল ওর ছোটবেলার বন্ধু, একসময় যাকে রোদেলা খুব বিশ্বাস করত। কিন্তু সে-ই একসময় রোদেলার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিল। অভ্র দেখে, রোদেলার মুখ কালো হয়ে গেছে।
বন্ধুটি আবার ফিরে বন্ধুত্ব করতে চায়। অভ্র পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু বলে না। কিন্তু রোদেলা বলে,
"তুমি এসেছো ঠিক আছে, কিন্তু আমি এখন ভালো আছি। আমি আর কাউকে আমার শান্তি নষ্ট করতে দেব না।"
সেইদিন রাতে, অভ্রকে ফোন করে রোদেলা বলেছিল,
"তুমি জানো? আগে আমি মনে করতাম ভালোবাসা মানেই কষ্ট। এখন বুঝি, ভালোবাসা মানে নিরাপত্তা। আর তুমি আমার নিরাপত্তা।"
অভ্র চুপচাপ বলেছিল,
"তুমি যদি রাগ করো, আমি সেটা সহ্য করব। তুমি যদি কাঁদো, আমি তোমার চোখ মুছে দেব। আর যদি ভালোবাসো, আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসব।"
রোদেলা হেসে বলেছিল,
"তুমি তো দেখছি পুরো কবি হয়ে গেছো!"
অভ্র বলেছিল,
"কারণ আমি একজন রাগি রাজকন্যার প্রেমে পড়েছি। সে তো আর সাধারণ কথা বোঝে না। তাকে তো মনের গভীর ভাষায় বলতে হয়!"
এখনো মাঝে মাঝে রোদেলা রাগ করে, অভ্রর ফোন কেটে দেয়, কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু অভ্র জানে, রোদেলা কিছু সময় নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। সে ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করে। আর রোদেলা জানে—এই ছেলেটা সত্যিই ওকে ভালোবাসে।
রাগের আড়ালে যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, অভ্র সেটা দেখেছিল প্রথম দিন থেকেই।
শেষ কথা:
ভালোবাসা মানে কখনো জোর করে কাউকে বদলে দেওয়া না। বরং তার সমস্ত দুর্বলতা, রাগ, ভয়—সবকিছুকে মেনে নিয়ে তাকে বোঝার নামই ভালোবাসা।
রোদেলা আর অভ্রর গল্পটা আমাদের শেখায়, রাগি মেয়েরা খারাপ হয় না—তারা শুধু একটু বেশি যত্ন খোঁজে, একটু গভীর ভালোবাসা চায়।
No comments:
Post a Comment
comment