ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশি আনন্দ।

Thursday, July 12, 2018

বউমা

ভালোবাসার গল্প, ভালবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, valobashar golpo, premer golpo, love story

আজ আমার বউমা'র বিয়ে। হ্যা আমার বউমাকে আমি নিজেই বিয়ে দিচ্ছি। খুব অল্প বয়সেই মেয়েটির জীবনের সব রঙ হারিয়েছে।মাত্রই অনার্স পাস করেই সুমাইয়াকে আমার কলিজার টুকরো, আমার বড় ছেলের বউ করে আনি। মেয়েটি এতটাই আন্তরিক ছিল, খুব অল্প কয়দিনেই বাড়ির সবার মন জয় করে ফেলেছিলো। কখন বউ থেকে মেয়ে হয়ে উঠলো বুঝতেই পারিনি।আমার ছেলেটা যেহেতু বিদেশে চলে যাবে, তাই আমি চাইতাম মেয়েটা যেন বাড়ির কাজ না করে নিজের রুমে সময় কাটায়। তারা স্বামী-স্ত্রীর সময় কাটাক।কিন্তু আমি যতক্ষণ রান্না ঘরে থাকতাম মেয়েটি রান্নাঘর ছেড়ে মোটেও যেতে চাইতো না। কত বকা দিয়েছি, কে শুনে কার কথা।

খুব চাইতাম সকালে যেন রুম থেকে বের না হয়। তাই আমি ফযরের নামাজ পড়ে খুব ধীরেধীরেই সকালের নাস্তা রেড়ি করতাম। কিন্তু কি অদ্ভুতভাবে সুমাইয়া টের পেয়ে যেতো। সেও রান্নাঘরে চলে আসতো।মাঝেমাঝে রাগ লাগতো।আমার সব কাজ আমি নিজেই করতে অভ্যস্ত। সুমুর হেল্পের কোন দরকারই ছিলো না। তবু মেয়েটি আমার পিছনে পিছনেই ঘুরঘুর করতো।
কতবার বলেছি,--আমার সাথে থাকার সময় অনেক পাবে।কিন্তু আমার ছেলেকে পাবে না। সে চলে যাবে। তাকে সময় দাও।

তারপরও মেয়েটি যেন আমার সাথে সময় কাটাতে ভালভাসতো। হয়তো ভয় পেত।আমার ছেলে যখন বিদেশে চলে গেল, মেয়েটি খুব কান্না করেছিল, খুব। আশা করেছিলো; কন্সিভ করবে।আমিও খুব করে চাচ্ছিলাম, আমার বংশের প্রথম নাতি/ নাতনি দুনিয়াতে আসুক।কিন্তু সুমুর মন খারাপ হবে তাই বলতাম,--তোমরা আধুনিক যুগের মানুষ, এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে কি করবে?

মেয়েটি প্রচণ্ড মন খারাপের মধ্যেও লজ্জা পেয়ে হাসতো। যেন আমরা শাশুড়ি, বউ মা নই। দুই বান্ধবী।
দুপুরে ছাদে বসে আমরা গল্প করতাম।একসাথে নামাজ আদায় করতাম, একসাথে ঘুমাতাম। যেহেতু ওর শ্বশুরও বিদেশে ছিলেন।শবে কদরের রাতে আমরা দুইজন সারারাত নামাজ পড়তাম। আমরা প্রায় সময় রাতে ঘুমানোর সময় গল্প করতাম। কখন আমরা একে অপরের বন্ধুতে পরিণত হয়েছি বুঝতেই পারিনি।
কেউ দেখলেই আমাদের মা মেয়ে বলতো।বলে না, দুনিয়ার কোন সুখই চিরস্থায়ী নয়।আসল সুখ জান্নাতে। দুনিয়াতে মানুষকে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

আমাদের জীবনও ঘন মেঘে ছেয়ে গেল।সুমুর বিয়ের দেড় বছর পর, খবর এল আমার ছেলেটা বিদেশে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমার কলিজার টুকরা, আমার বড় ছেলের মৃত্যু মেনে নেওয়া আমার জন্য খুবই কষ্টের ছিল।আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু সুমুকে সামলানোর জন্য আমাকে শক্ত হওয়ার ভান ধরতে হল। নিজের কষ্টকে মাটি চাপা দিয়ে, সুমুর এক সাগর কষ্ট দূর করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম। মেয়ে নাওয়া, খাওয়া ভুলে গিয়েছিললো। সুমুর বাবা-মা সুমুকে নিতে এসেছিলো। কিন্তু মেয়েটি স্বামীর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছে। যায়নি বাবার বাড়ি।

কয়েকমাস পর সুমুকে ব্যস্ত রাখার জন্য, একপ্রকার জোর করেই চাকরি করার প্রিপারেশন নিতে বললাম।
মেয়েটি প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়, শুধু আমার কথা রাখার জন্য। খুব বুঝতে পারছিলাম তার মন এখন কোন কিছুতেই ভাল হবে না। কিন্তু আমি জানি একবার চাকরি হয়ে গেলেই আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে গেলে সবকিছু হয়তো নরমাল হয়ে যাবে।একটা স্কুলে চাকরি হয়েও গেল।সারাদিন সুমুর সামনে হাসিখুশির অভিনয় করতাম। কিন্তু রাত হলেই কলিজাটা ছিঁড়ে যেতে চাইতো। বুকটা ফেটে যেত। বুঝতে পারতাম, মেয়েটিও সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও প্রতিরাতেই কাঁদতো।আল্লাহকে বলতাম,--ওহ আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে না নিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেনা কেন? এই নিস্পাপ পবিত্র মেয়েটির কষ্ট দেখতে হতো না।

এবার আমাকে কিছু একটা করতেই হবে।কয়েকজনকে বলে রাখলাম। আমার বউমার জন্য কোন ভাল পাত্র পেলে আমাকে জানাইও।সবাই ছিঃ ছিঃ করে উঠল।অনেকেই কানাঘুষো করতে লাগল, কেন আমি বউমার বিয়ে দিচ্ছি।ওরাতো জানে না, সুমু শুধু বউমা নয়।আরো অনেক কিছু। পরিবারের সবাই, এমন কি সুমু নিজেও বিয়ের ব্যপারে খুব নারাজ।আমি পরিবারের সবাইকে রাজি করালাম।সুমু অনেক কান্না করল।বলল,--মা আমি খুব বোঝা হয়ে গেছি না? আমাকে আর সহ্য হচ্ছে না? আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি কি? আমি আমার বাবার বাড়ি যায়নি শুধু আপনার ছেলের স্মৃতি এই বাড়িতে বলেই। কেন আপনি আমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়াতে চাচ্ছেন। আপনি যেভাবে বলবেন আমি সেভাবে করব তারপরও এই বাড়ি থেকে চলে যেতে বলবেন না।

বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।আমি ভাবতে লাগলাম, চার মাস কয়দিনের জন্যই মেয়েটি স্বামীকে পেয়েছিলো। কিভাবে কাউকে এত কম সময়ে এত গভীরভাবে ভালবাসতে পারে। লোকে বলে,"কেউ বছরের পর বছর একই ছাদের নীচে থেকেও একে অপরকে ভালবাসতে পারে না। আবার কেউ অতি অল্প সময়ের জন্য কাছে পেয়েই একে অপরের জন্য জান দিতে পারে" কথাটি বোধহয় মিথ্যা নয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,--মা'রে, আমি, আমরা, তোর বাবা মা কেউই তোর পাশে চিরজীবন থাকব না। এখনো তোর বয়স খুবই কম। এই কঠিন দুনিয়াতে স্বামী ছাড়া বিবাহিত সুন্দরী মেয়েদের ঠিকে থাকা খুব কষ্টের।

বহু অনুনয় বিনয় করার পর মেয়েটি রাজি হল।এবার সমস্যা দেখা দিল, সবাই যে সম্পর্ক গুলো আনে সবগুলোতেই পাত্র হয় স্ত্রী মারা গেছে, নয়তো স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছে, নয়তো সন্তান আছে। কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম, এইধরনের কাউকেই বিয়ে দিব না। মেয়েটি অনেক কষ্ট সয়েছে। এমন কাউকে বিয়ে দিতে পারব না যার হৃদয়ে অলরেডি অন্য কারো স্মৃতি। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম, এমন সম্পর্ক যেন কেউ না আনে। আমার বিয়ে দিতে তাড়া নেই।সময় লাগুক সমস্যা নেই।লোকে কত কথা শুনাল।অনেকে সামনাসামনিই বলল,--যেন আপনাদের বউ কুমারী। অন্যকে দেখার আগে নিজে কেমন দেখে নিন।

আমার এত কিছু দেখার প্রয়োজন নেই।আমি জানি আমার বউমা সুন্দরি, শিক্ষিতা, ধার্মিকা, পর্দানশীন। ওর মত মেয়ে লাখেও পাওয়া যাবে না। যে কোন প্রেক্টিসিং ওর মত মেয়ে পেলে অত্যন্ত আনন্দের সাথেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। এর এক বছর পরেই, ভাল বেতনের চাকরি করে একজন প্রেক্টিসিং পাত্র সবকিছু জেনে শুনেই নিজে থেকেই সুমুকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। ছেলেটির নাম ইয়াসির।ছেলেটি বলল,--এমন একজন প্রেক্টিসিং মেয়ের জন্যই এতদিন অপেক্ষা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। যদি আপনারা যোগ্য মনে করেন, তাহলে বিয়ের ব্যবস্থা করুন। আমার অভিভাবক বলতে একটা বোন ছাড়া কেউই নেই। মা বাবা মারা গেছেন বহু আগেই।

সুমু ছেলেটির সাথে কথা বলে, সম্মতি জানাল। সেদিন আমি জানিনা, আমি খুশি হয়েছি, না সুমুকে হারানোর ব্যথায় কান্না করছিলাম। প্রচণ্ড কান্না করেছি। বিয়ের সব আয়োজন আমি নিজেই করেছি। কিছুক্ষণ পরেই সুমুর বিদায়, আমার কলিজাটা ফেটে যেতে চাচ্ছে। এতদিন পরেই খুব ভয়ঙ্করভাবে বুঝতে পারলাম, আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি। আবার আমার একাকিত্ব শুরু। খুব খুব কান্না করলাম সুমুকে জড়িয়ে ধরে। জানিনা আমার সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে। শুধু এইটুকুই জানি আমার সুমু ভাল থাকবে। সুখে থাকবে, খুব খুব হাসিখুশি থাকবে।

No comments:

Post a Comment

comment

Contact Us

Name

Email *

Message *