- এই ছেলে,এই?
এই ছেলে শুনো?
বেশ কতক্ষণ ধরে ডাকছেন তিনি।
তিনি মানে মহিলাটাকে আমি চিনিনা।মহিলা বলার কারণ হলো তিনি বয়স্ক। সুন্দরী কোনো রমণী হলে, "এই চ্যাংড়া শোন" বলেও যদি ডাকতো তবুও দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম।
যদিও আমার উচিৎ তার ডাক শোনা। জিজ্ঞাসা করা কেন ডাকছে আর আদৌ কি আমাকেই ডাকছে নাকি অন্য কাউকে। কিন্তু কেন যেন আমার পিছনে তাকে দৌড়ানোতে পৈশাচিক এক আনন্দ পাচ্ছি। যদিও এটা অভদ্রতা। কিন্তু কথা হলো আমি মোটেও ভদ্র ছেলে নই। তাই না শোনার ভান করে এগিয়ে যাচ্ছি। একসময় সে অনেকটা দৌড়ে এসেই সামনে দাঁড়ালো। আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
:এতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনছো না কেন? সমস্যা কী হ্যাঁ?
: এই ছেলে,এই ছেলে কেমন ডাক হ্যাঁ?আর আমাকেই যে ডাকছেন কীভাবে বুঝবো?এই নামে ডাকলে কেন শুনবো আমি?
: তো নাম না জানলে কি বলে ডাকবো?
: এই ছেলে,এই ছেলে না বলে যদি বলতেন,"এই যে বাবা শোনো তো একটু" তাহলেই শুনতাম।
: বাবা কেন বলবো তোমাকে?
: কেন আপনার কি কোনো মেয়ে নাই?
: মেয়ের সাথে বাবা ডাকের কি সম্পর্ক?
: ও,সরকারি চাকরি খুঁজছেন বুঝেছি। সমস্যা নাই, খুঁজেন। আমরা বেকাররাও চাকরি পাবো। আমরাও একদিন বিয়ে করবো।
: এই ছেলে, তুমি পাগল নাকি? কী বলছো এসব?
বলদা মহিলা, কিচ্ছু বুঝে না। (মনে মনে)
: ডাকলেন কেন তাই বলেন।
: কী আর বলবো। তোমার কথা শুনে সব আউলে গেছে।
: আচ্ছা বাসায় চলে যান তাহলে। আপনার মেয়ের কোনো বিএফ আছে কি না সেটা জেনে আর আউলে যাওয়া কথা গুছিয়ে নিয়ে আগামীকাল এই সময় এই রাস্তাতেই এসে দাঁড়াবেন। একটু দেরি হতে পারে বা আগেও আসতে পারি। টিউশনি শেষ হতে যতক্ষণ। আপনি হাতে একটু বেশি সময় নিয়েই আসবেন, কেমন?
বলেই তাকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
ভেবেছিলাম সে আবার ডাকবে। কিন্তু ডাকলো না। আমিও আর পিছনে ফিরলাম না।
সোজা মেসে চলে আসলাম। মেসের বুয়া আসেনি। ভাত রান্না করার মতো চাল আছে। কিন্তু আর কিছুই নাই। একটা ডিম যে কিনবো সেই টাকাও নাই পকেটে। আমার পাশের রুমে এক বড় ভাই আছে। সে সারাদিন রুমেই শুয়ে থাকে। আর কিসব কবিতা লিখে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সে বাংলা কবিতা লিখে কিন্তু তার সাথে কথা বলতে গেলে সে নেরাজি(আই মিন ইংরেজি) ছাড়া কথা বলে না। যদিও তার কবিতার আগামাথা কিছুই বুঝিনা আমি।
একটা সুবিধা আছে। তার সাথে দুই চারটে ইংরেজি বলতে পারলে সে অদ্ভুত রকমের খুশি হয়। তার এই খুশি ভাবটা অনেক ভালো লাগে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমি নেরাজি বুঝিনা। বলতেও পারিনা। নেরাজিতে আমি কখনো বি গ্রেডের উপরে পাইনি।
যাইহোক,তবুও তার কাছেই যেতে হবে আমার। মেসে একমাত্র সেই আছে যার কাছে মাস শেষেও টাকা থাকে। কিন্তু সে কাউকে খুব সহজে ধার দেয়না।তাকে খুশি করতে পারলে তাহলে সম্ভব।
আমার অবশ্য একটা সুবিধা আছে।তিনি আমাকে মোটামুটি রকমের পছন্দ করেন। কেন পছন্দ করেন সেটা কখনো জিজ্ঞাসা করিনি। করতে ইচ্ছাও করেনা।
ভেতরে ঢুকতেই ভাই বললো,
: হ্যালো,মৃদু পাগলা।হাউ আর ইউ?
: এইতো ভাই,আপনি কেমন আছেন?
: You'll never say I'm fine, it's always the same! Why?
: এই ধরেন খুশিতে, ঠ্যালায়, ভাল্লাগে।
: শাটআপ! এমন থার্ডক্লাস মার্কা ডায়লগ আমার সামনে বলবে না। এই নাও টাকা। যাও বাইরে থেকে খেয়ে আসো৷ সব টাকা খরচ করো না। বুয়া রাতেও আসবে না৷
: আপনি কী করে বুঝলেন আমি টাকার জন্য এসেছি?
: আমি জানি।আর এটাও জানি আমি ইংরেজি বেশি বলি। যেটা তোমার পছন্দ না। তাই খুব জরুরি দরকার ছাড়া তুমি আমার কাছে আসো না।আমার সাথে কথা বলতে চাও না। আমি কি ঠিক বলেছি?
তার কথার উত্তর দিলাম না। সে নিজেও জানে সে ঠিকই বলেছে। আমার উত্তরে কিছু যায় আসেনা। রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। একশো টাকা দিয়েছে। পকেটে এটা ছাড়া আর কোনো টাকা নেই৷
এখন আর খাবো না। পাঁচটার দিকে আরেকটা টিউশনি আছে। এখন সাড়ে তিনটা বাজে। ওখানে গেলে হালকা-পাতলা নাস্তা দিবেই। ওটার পরে আবার সাতটার টিউশনি। সেখানেও নাস্তা খাওয়া হবে। আর কপাল ভালো থাকলে রাতের খাবারটা ওখানেই হয়ে যেতে পারে। নেহার বাবা (মানে আমার ছাত্রীর বাবা) সে এই সপ্তাহেই আসার কথা। কিসের এক কাজে যেন দেশের বাইরে গেছে। সে প্রায়ই দেশের বাইরে যায়। যখন ফিরে তখন বেশ আয়োজন থাকে। তখন তার বাসাতেই খেয়ে আসতে হয়। না খাইয়ে তো নেহা ছাড়েই না।
ইদানীং একটু সমস্যা হচ্ছে। নেহা মেয়েটার ভাবগতি ভালো মনে হচ্ছে না। আগে তো শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো। ইদানীং চিঠিও লেখা শুরু করেছে। ক্লাস সেভেনের মেয়ে। এই বয়সে এমন হাবভাব মোটেও ভালো নয়। কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। টিউশনিটা খুব শীগ্রই ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো বাকি তিনটি টিউশনি করে যে টাকা পাই সে টাকা এই একটা থেকেই পাই। এটা ছাড়লে চলা খুব কঠিন হয়ে যাবে।
দোকান থেকে এক কাপ চা খেলাম। দোকানদারের নাম ময়েন। আজ তার ছেলের জন্মদিন। তাই বিশেষ বিশেষ লোককে সে ফ্রি চা খাওয়াচ্ছে। আমি যে ওর কাছে বিশেষ লোক এটা আজ জানলাম।
পাঁচটার টিউশনিতে কোনো খাওয়া হলো না। ছাত্রের মা বাসায় নেই। সে আর তার বড় বোন বাসায় আছে। বিস্কুট কই আছে ছাত্র তা জানে না। চাও সে বানাতে পারে না। তাই শুধু পানি নিয়ে আসছে। একবার জিজ্ঞাসা করতে চাইলাম,
তোমার আপুও কি জানে না?
কিন্তু নাহহ। এটা করা ঠিক হবে না।
সেখান থেকে বের হয়ে চা আর বিস্কুট খেলাম।
তারপর পরের টিউশনিতে গেলাম। বাসায় ঢুকেই অন্যরকম আবহাওয়া পেলাম। নেহার বাবা এসেছে। কিন্তু বাসাটা কেমন যেন গম্ভীর লাগছে। উনি আসলে বাসা চঞ্চল থাকে। আজ এমন কেন বুঝলাম না। কাজের মেয়েটা দরজা খুলেই কেমন যেন বিতৃষ্ণা ভরা চোখে তাকিয়ে বললো, স্যার আপনাকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলেছেন।
: পড়ানো শেষ করে বসবো। আগে পড়াই?
: পড়ানো পরে। আগে বসেন গিয়ে।
গিয়ে বসলাম। ড্রয়িং রুম খালি। একদম সুনসান। অন্যান্য দিন টিভি চলতো। আজ টিভিও চলছে না। বিরাট বড় একটা টিভি দেয়ালের সাথে সেট করা। এতবড় টিভিতে কিছু দেখতে ভালোই লাগে। টিভিটা কি চালু করে দিবো? নাহহ! থাক। কি হয়েছে আগে এটা জেনে নেই।
পেত্নীর সাথে অনেকদিন হলো কথা হয়না। ফোন দেওয়া দরকার। কিন্তু নাম্বারগুলো ডিলিট করে দিয়েছি। ইচ্ছে করলে নাম্বার জোগাড় করতে পারবো। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা আর করেনা। শুধু একটা কথাই মনে পড়ে,কোন মুখে কথা বলবো তার সাথে।
হঠাৎ নেহা যেন কোথা থেকে দৌড়ে আসলো। এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
: স্যার,স্যার, আমি বাবাকে আমাদের কথা বলেছি। বাবা বলেছে আপনার সাথে কথা বলবে। আপনি কিন্তু বাবাকে বুঝিয়ে বলবেন।
: কী বলেছো তুমি? আর আমি কী বুঝিয়ে বলবো?
: আপনি এতো বোকা কেন স্যার? আপনার আর আমার বিয়ের কথা বলেছি বাবাকে। প্লিজ প্লিজ আপনি বাবাকে ম্যানেজ করবেন।
তার কথা শুনে থ মেরে রইলাম। কি বলবো বা বলা উচিৎ,কিছু মাথায় আসছে না। এতবড় ঝামেলার বিষয়টি সে এত স্বাভাবিক আর প্রফুল্লচিত্তে বলছে,
আমি শুধু হা করে তাকিয়ে দেখছি।
: স্যার! এত দেখতে হবে না। বিয়ের পরে দেইখেন। বাবা এখনই আসবে। আমি চললাম৷
এটা বলেই সে দৌড়ে চলে গেলো।
নেহার বাবা একটু পরে ঢুকলো। তার সাথে আন্টি এবং আরেকজন হলো আমার ফ্রেন্ড।যার রেফারেন্সেই এই টিউশনিটা পেয়েছিলাম। তাদের দেখেই বুঝা যাচ্ছে আমার আর এই টিউশনি ছাড়তে হবে না। তারাই আমাকে বিদায় করবে।
এসেই বন্ধু বলল,
: তোকে আমি দয়া করেছিলাম৷ আর সেই দয়ার এই প্রতিদান দিলি? কখনোই ভাবিনি এটা করবি তুই।
তারপর আংকেল বলল,
তোমার ফোনটা দাও। ফোনটা নিয়ে সিম আর মেমোরি খুলে রেখে দিলেন৷ তারপর বললেন,
এই সিমটা যেন আর ওপেন না হয়।তোমাকেও যেন এই এলাকায় আর কখনো না দেখি। এক্ষুণি বিদায় হও তুমি।
কিছু না বলে চলে আসলাম। বলার অনেক কিছুই আছে। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে না৷ অবিশ্বাস যেখানে ঘর করেছে সেখানে বিশ্বাসী হওয়ার তর্কে জয়ী হতে চাই না।
হোটেল থেকে খেয়ে মেসে চলে আসলাম। ফোনটা বন্ধ পড়ে আছে। সিম কেনার টাকা নেই। পরেরদিন সকালে একটা টিউশনির টাকা পেলাম। সেটা নিয়ে বিকেলে বাড়ি চলে আসলাম৷ স্থান পরিবর্তন স্মৃতি ভোলার সহজ মাধ্যম। কিছুদিন বাড়িতে থাকলে সব মাথা থেকে ঝরে যাবে।
পাঁচদিন পরে মেসে এসে শুনলাম সালমান (মানে সেই বন্ধু যার রেফারেন্সে নেহাকে পড়াতাম।) এসেছিলো। সিমটা দিয়ে গেছে। আর একটা চিঠি দিয়ে গেছে।
চিঠিতে লেখা,
সরি বন্ধু, নেহার কাছে সব কিছু শুনেছি। না জেনে তোকে ভুল বুঝেছি। তোর সামনাসামনি আর হতে পারছি না। প্লিজ কিছু মনে করিস না।
চিঠিটা রেখে বেরিয়ে পড়লাম। দুপুরে টিউশনি শেষ করে আসার সময় দেখলাম আন্টি দাঁড়িয়ে আছে। আজ সে ডাকার আগেই দাঁড়িয়ে পড়লাম।
: তোমার নাম মৃদু?
: নাহহ। মৃদুল আমার নাম।
: তাহলে মৃদু কার নাম?
: আমারই নাম। একজনের দেওয়া নাম এটা। তাই নামটা শুধু তার জন্য। আর কারো জন্য না। তবে ডাকতে পারেন৷ এই নামে কেউ যখন আমায় ডাকে তখন মনে হয় সেই ডাকছে। হাজার মন খারাপ থাকলেও মনটা তখন ভালো হয়ে যায়৷
: মৃদু নামে ডাকলে নাকি পাপ হবে৷ তাই আর ডাকে না। আমি কি ঠিক বললাম?
: জ্বি। ঠিক বলেছেন। তবে পাপ না।সে যেটা ভেবে আমাকে নাম দিয়েছে আসলে আমি তা নই। তাই আমার প্রতি তার ঘৃণা জন্মেছে। ঘৃণা থেকে সে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
: আমি কে জিজ্ঞাসা করবে না?
: নাহহ। আপনি পেত্নীর খালা। জানি তাই জিগ্যেস করার প্রয়োজন নেই।
: ও আচ্ছা। তাহলে সেদিন অচেনার ভান করলে কেন?
: এমনিই, কোনো কারণ নেই। আর সেদিন আপনিও তো আমার নাম জানার পরেও এই ছেলে এই ছেলে বলে ডেকেছেন।
: আচ্ছা বুঝলাম। এখন বলো আমি কেন এসেছি? আর কেন তোমাকে ডাকছি?
: পেত্নীর বিয়ের খবর দিতে।
তিনি অনেকটা অবাক হলেন। বিস্ময়কর মুখে বললেন,
: জানো তুমি সব?
তাকে আর কিছু বললাম না। মুচকি হেসে হাঁটতে শুরু করলাম।
কিছু হাসির মানে শুধু আনন্দ নয়। মনকে তৃপ্ত করে না।
আজ আর সে আমার পিছনে দৌড়াচ্ছে না। শুধু পিছন থেকে ডাকছে।
এই ছেলে, এই।
Md Abdul Alim |
No comments:
Post a Comment
comment