ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশি আনন্দ।

Sunday, December 29, 2019

চকোলেট

love story, valobashar golpo, ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প
গল্প লিখি, গল্প খুঁজি, সেই সাথে খুঁজতে থাকি গল্প পাঠক। অন্যরকম এক কলম্বাস হয়ে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে একদিন আবিস্কার করলাম আমাদের এলাকার একমাত্র সরকারী কলেজের বাংলা ম্যাডামকে। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দুজনে একসাথে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলাম। বই পড়া বিষয়ক উনার চমত্কার বক্তব্য শুনে যখন বুঝলাম উনি পড়তে ভালবাসেন, তখন ব্যাংকার পরিচয়ের আড়ালে একজন শখের লেখক হিসেবে নিজের পরিচয় দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। পরিচয় জেনে ম্যাডাম তার বাসায় নিমন্ত্রণ জানালেন গল্প শুনার জন্য।
পাঠকেরর এই আকালের যুগে ম্যাডামের নিমন্ত্রণ আমাকে যেন মরুভূমিতে বৃষ্টির পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেল। দেরী না করে পরদিন গিয়ে উপস্থিত হলাম ম্যাডামের বাসায়। যাবার সময় একটা চকোলেট কিনে নিলাম তার জন্য। আমার মতে মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে চকোলেট খাবার সময়টাতে। মেয়েরা যখন চোখ বুজে চকোলেটের স্বাদ নিতে থাকে, তখন মনে হয় স্বর্গ থেকে কোন অপ্সরী মাটিতে নেমে এসেছে। মেয়েরা হৃদয় দিয়ে চকোলেট খেতে জানে, ছেলেরা যেমনটা জানে সিগারেট টানতে।
গন্তব্যে পৌছে জানতে পারলাম ম্যাডাম তার দুইজন ছাত্রী নিয়ে মেস করে এখানে থাকছেন। আমাকে বসতে দিলে পকেট থেকে চকোলেটটা বের করে দিলাম। কিন্তু না, চকোলেট পেয়ে খুশি হয়ে হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়েও হঠাত্ করে হাত গুটিয়ে নিলেন। আমি কি কোন ভুল করে ফেললাম? জানতে পারলাম, তিনি চকোলেট খান না। ওটা নাকি উনার লাগবে না। চকোলেট খান না, ভাল কথা। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো রিঅ্যাক্ট করার কোন কারন খুঁজে পেলাম না। যা হোক, শুরুতে এ বিষয় নিয়ে ত্যানা না প্যাচিয়ে গল্প পড়ে শুনানো শুরু করলাম। মাঝখানে লিজা নামের ছাত্রীটা এসে চা দিয়ে গেল। পুরো গল্পটা শুনে ম্যাডাম খুব প্রশংসা করলেন, ভাষাগত কিছু ভুল ধরিয়ে দিলেন এবং শেষে শুরুর ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলেন।
গল্প খুঁজে বেড়ানো মানুষ আমি; গল্পের গন্ধ পেলে তা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাই না। তাই তাকে তার চকোলেট কাহিনী টা জানাতে উদ্বুদ্ধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে একসময় সফল হলাম। গল্পটা তার মুখেই শুনা যাক:
আমি তখন ক্লাস নাইনে উঠেছি। ইংরেজী পড়ানোর জন্য নতুন একজন হাউস টিউটর রাখা হল। তাকে বাবু স্যার নামেই সবাই চিনে। বাবু স্যার প্রথম দিন আমার জন্য একটা চকোলেট নিয়ে আসলেন। তার কাছ থেকে আমার প্রিয় চকোলেট পেয়ে যার পর নাই খুশি হলাম। এভাবে তিনি রোজ আসার সময় আমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসতেন। আমি তার সামনেই চকোলেট খেয়ে পড়া শুরু করতাম। ধীরে ধীরে স্যারকে আমার ভাল লাগতে থাকল। এভাবে সময়ের সাথে সাথে এক সময় বুঝতে পারলাম এখন আর আমার রক্ষে নেই। বাবু স্যার ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারবো না। আমি স্যারের প্রেমে পুরোপুরি মজে গেলাম। স্যারকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি, ভয়ও করি। কী করা, কী করা, কী করা? স্যারকে ব্যাপারটা কিভাবে যে বলি! প্রতিদিন নিয়ম করে নিজেকে তৈরী করতাম স্যারকে ব্যাপারটা জানানোর জন্য। কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করেই কাজটাতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। ব্যর্থ হতে হতে একদিন সত্যি সত্যি সাহস পেয়ে গেলাম। আর দেরী করা চলে না। স্যারকে জানাতেই হবে ব্যাপারটা। স্যার আসলেন, বসলেন তার চেয়ারে। আমি চকোলেটের অপেক্ষা করতে থাকলাম। চকোলেটটা খেয়েই স্যারকে কথাটা বলা হবে। ওদিকে স্যার কিন্তু আর চকোলেট বের করে দেন না। আমি অপেক্ষা করি। না, চকোলেট স্যারের হাতে আর উঠে আসে না। একসময় আমি নিজেই বলি, স্যার আমার চকোলেট? স্যার জানান তিনি চকোলেট আনতে ভুলে গেছেন। আমার খুব খারাপ লাগে। গো ধরে বসি। আমার চকোলেট না পেলে পড়বো না। অগত্যা স্যার আমাকে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে চকোলেট নিয়ে আসতে বাইরে যান। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। এক মিনিট .. দুই মিনিট.. পাঁচ মিনিট... দশ মিনিট... এক ঘন্টা। স্যার আর আসে না।একমাস কেটে গেল, স্যারের কোন খোঁজ নেই। এর মধ্যেই আব্বা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন। আমরা সবাই আব্বার সাথে ফরিদপুর চলে গেলাম। তারপর আমার বাবু স্যারকে আর কোথাও খুঁজে পাইনি। স্যার যে তার জন্য পাগলপারা একটা মেয়েকে ওভাবে বসিয়ে রেখে রাগ করে চলে যাবেন, এমনটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। সেই থেকেই প্রতিজ্ঞা করি চকোলেট এই জীবনে আমি আর কখনো খাবো না, কখনো না।
ম্যাডামের গলা ধরে আসলো, তিনি চুপ হয়ে বসে থাকলেন। তার এই করুন কাহিনীটা শুনে আমিও তার মতো করেই কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকলাম। ধাতস্থ হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
আপনার ডাক নামটাতো এখনো জানা হলো না।
তুলি।
আচ্ছা তুলি, আপনার এই কাহিনীটা আমাকে একটা গল্প রচনার সুযোগ করে দিল।চমৎকার হবে গল্পটা।
আমার কাহিনী নিয়ে গল্প লিখবেন আপনি!
হু, যদি অনুমতি পাই।
আশ্চর্য! অনুমতির আবার কি হলো। তা আমার এ গল্প থেকে কি গল্প তৈরী করলেন, শুনানো যাবে?
গল্পটা যেহেতু আপনাকে নিয়ে এটা সবার আগে শুনার অধিকার আপনারই। আপনি যতোটুকু বল্লেন, তার পর থেকে শুরু করা যাক, কি বলেন?
ঠিক আছে, করা যাক।
ধরা যাক, আপনার অজান্তেই আপনার স্যার ও আপনাকে ভালবেসে ফেললেন। কিন্তু তিনি সেটা আপনাকে বলতে পারছিলেন না কারন, আপনাকে ভালবেসে তিনি একধরনের অপরাধবোধে ভুগছিলেন। তিনি আপনার শিক্ষক। শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর প্রেমে পড়বেন, ব্যাপারটা তিনি ঠিক মানতে পারছিলেন না। আপনাকে ভুলে থাকার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তিনি বুঝলেন আপনাকে ছাড়া আর কাউকে তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না। একদিন তিনি ঠিক করলেন ব্যাপারটা আপনাকে জানাবেন। ঠিক করলেন, সেদিন আপনাকে আর চকোলেট না দিয়ে তার ভালবাসার কথাটাই উপহার দিবেন। কিন্তু আপনি শুরুতেই যখন জেদ করলেন চকোলেট ছাড়া আপনি পড়বেন না। তখন বাধ্য হয়েই চকোলেট কিনতে বের হলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রাস্তা ক্রস করার সময় এক্সিডেন্ট করলেন। তার পা ভেঙে গেল। এক মাসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাকে। এই এক মাসে অনেক কিছুই ঘটল। তার দাড়ি- গোঁফ লম্বা হয়ে গেল, আপনার আব্বা ট্রান্সফার হলেন, আপনারা সবাই ঢাকা ছাড়লেন। সুস্থ হয়ে স্যার আর আপনাকে খুঁজে পেলেন না। তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। আপনাকে একদিন না একদিন পাবেন এই বিশ্বাসে তিনি বিয়ে করলেন না। তিনি হয়তো আজো পকেটে চকোলেট নিয়ে আপনাকে খুঁজে চলেছেন।
গল্প শুনা শেষ হলে ম্যাডাম আনন্দিত হয়ে আমার গল্প তৈরীর ক্ষমতার প্রশংসা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, গল্প কেন বাস্তব হয় না, বলতে পারেন। তারপর ভেতরের রুমে গিয়ে একটা কার্ড এনে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। আসলে খুশী হবো।
ম্যাডামের বাসা থেকে বের হলাম। হাতে কার্ড। চকোলেটটা ইচ্ছে করেই ফেলে এসেছি। বিয়ের কার্ড হাতে পাবার পর আর ইচ্ছে হলো না নিজের পরিচয় দেওয়ার। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে’!

লিখেছেনঃ
 Kais Shami

No comments:

Post a Comment

comment

Contact Us

Name

Email *

Message *