ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশি আনন্দ।

Monday, November 30, 2020

শিরোনামহীন গল্প

 

love story, valobashar golpo, ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প ভালবাসার গল্প
Add caption

"খোকা বলছিলাম কি নীলাকে এবার ডিভোর্সটা দিয়ে দে,আর না হয় দ্বিতীয় আরেকটা বিয়ে করে নে ।"

নতুন অফিসে জয়েনিং দিনের শুরুতে মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ভ্রু কুচকে গেলো আমার নিজের অজান্তে।পিছন ফিরে তাকাতে মা আবার বলা শুরু করলো..

"আর কতদিন এভাবে চলবে?মেয়েটা সত্যি অলক্ষুণে,এ বাড়িতে আসার পর থেকে পরিবারের ভালোর চায়তে খারাপটাই বেশি হচ্ছে।তুই-ই দেখ,বিয়ের আগে পরিবারটা কত হাসি-খুশি ছিলো,আর এখন সবাই দূরে সরে গিয়েছে।তোর পর পর তিন তিনবার চাকুরি চলে গেলো।তোর বাবা এক্সিডেন্ট করে পা ভেঙ্গে বসে আছে।এইসব কি অলক্ষুণে নয়?
আর এখন তো একটা বাচ্চাও দিতে পারছে না,তাহলে তাকে রেখে কি লাভ?আত্মীয়রা সবাই কানাকানি করে,যে আমাদের বউমা নাকি বন্ধ্যা!তাঁর নাকি বাচ্চা দেওয়ার সামর্থ নাই।

আমি জুতাটা পায়ে দিয়ে সোজা হয়ে বললাম," মা চুপ থাকবা তুমি,নতুন একটা কাজে জয়েনিং সময়ে তুমি এসব কথা বলে কেন মনটা খারাপ করে দিচ্ছো।আমি এইসব নিয়ে পরে ভেবে দেখবো।

রুম থেকে বার হতে যাবো,ঠিক তখনি নীলার সাথে দরজার মুখে দেখা।
তার চোখ দুটি অশ্রুতে ছলছল করলেও আমাকে নিছক লুকানোর চেষ্টা করে বললো,"এই নাও তোমার জুস,খেয়ে নাও।
আমি নীলার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে জুসটা খেয়ে বার হয়ে আসলাম।

জানি না,বাসায় আজকে আবার কি না কি হয়!কয়েকমাস আগেও হাসি-খুশি থাকা সংসারটা এখন কেন যানি গুমুট ধরা বদ্ধ রুমের ন্যায় হয়ে গিয়েছে।দরকার ছাড়া কেউ কারো সাথে কথা বলে না।
সবারই একটাই অভিযোগ,নীলাকে যেন আমি ডিভোর্স দিয়ে দেই।
তবে সবার ভিতরেও যেই মানুষটা আমাকে সাপোর্ট করেন,তিনি আমার বাবা।ক্ষতিটা তারই সবচায়তে বেশি হয়েছে,তবুও তিনি নীলাকে তার মেয়ের চায়তে বেশি ভালোবাসেন।
বাসায় বাবায় একমাত্র মানুষ,যার কাছে নীলা দু দন্ড শান্তিতে কথা বলতে পারে।

নীলাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম,চেহারাতে খুব একটা ফর্সা ভাব আর লাবন্যতা না থাকলেও তার চোখ দুটিতে ভিষণ মায়া,আর তার আকাশ সমান উদরতার বিশালতা দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি।আমাদের প্রথম দেখাটা হয়েছিলো একটু সিনেমাটিক পদ্ধতিতে।
রাস্তার পাশের ফাঁকা একটা পার্কে কতকগুলো বাস্তহারা পথশিশুদেরকে পড়াতো সে।অফিস থেকে ফেরার সময় রোজ সন্ধ্যায় দেখতাম।
তখনো ওর মুখটাকে ভালোমতো দেখা হয় নি আমার।তবে কেন যানি এখনকার এই স্বার্থপরতার দুনিয়াতে এমন মহানুভবতা দেখে একধরনের ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করেছিলো।কয়েকসপ্তাহ দূর থেকে দেখে দেখে সাহস সঞ্চয় করে একদিন পার্কের ভিতরে ঢুকেই পড়লাম,সামনা-সামনি হওয়ার জন্য।
পার্কের ভিতরে থাকা একটা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে পড়াতো সে।পার্কের ভিতরে ঢুকলেও কেন যানি সাহস হলো না,সামনে যাওয়ার।
এভাবে আরো কয়েকটা দিন পার হওয়ার পর একদিন বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।মেয়েটা বার হলো,সাথে কয়েকজন বাচ্চা-কাচ্চাও আছে।
সবাই তাকে আপু মনি বলছে।
এই প্রথমবারের মত কোনো শিক্ষিকাকে আপুমনি বলে সম্বোধন করতে শুনলাম।ওদের আচরণ দেখে যা মনে হলো,তাদের সাথে মেয়েটার বেশ দীর্ঘদিনের সম্পর্ক।
খুব ভালো লাগলো,আজকালকার যুগে এমন মানুষ আছে দেখে।
বাচ্চারা সবাই যে যার মত চলে গেলে আমি নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,"এক্সকিউজ মি!

দীর্ঘ একমাস পরে সেদিনই প্রথমবারের মত দেখেছিলাম তাঁর মুখটা।শ্যামবর্ণ গায়ের রং,নরমাল বেশেই তাকে বেশ সুন্দরী আর মায়াবী লাগছিলো।
সেই জন্যই হয়তো গুনি সাহিত্যিকরা বলে গেছেন,নারীদের সুন্দরী হতে দামি মেকআপ আর ড্রেসআপের প্রয়োজন পড়ে না,শুধু মাত্র মুখের মায়াবী ছাপটাই যথেষ্ট একজন পুরুষের হৃদয়কে ঘায়েল করার জন্য।

-জ্বী বলুন।

আর এভাবে একজন অপরিচিতার সঙ্গে পরচিয় হয় আমার।আমি তাকে কখনো ভালোবাসার জন্য প্রপোজ করি নি।
বা বন্ধু হওয়ার জন্যও বলি নি,কয়েকদিনের পরিচয়ে সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।অবশ্য নীলা খানিকটা অবাকও হয়েছিলো,তারপর রাজিও হয়ে গিয়েছিলো।
বাবাকে নীলার কথা জানালে বাবাও নীলাকে পছন্দ করে ফেলে,তবে মায়ের অমত ছিলো।কারণ মা আগে হতেই তার বান্ধবীর মর্ডাণ মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কথা বলে রেখেছিলো।
অনেক ঝামেলার পর দু পরিবারের সম্মতিতে পারিবারির ভাবেই বিয়েটা করে ফেলি আমরা।তবে এখন কেন যানি সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

প্রথমদিনের অফিস মোটামোটি ভালো গেলো।অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতেই মা ডেকে বললো,"কি রে খোকা কিছু ভাবলি।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম,"নীলা,এই নীলা শোনো।

নীলা আমার ডাক শুনে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বার হয়ে এসে বললো,"কখন আসলে,গরম পানি করে দিচ্ছি আমি দাঁড়াও।

-গরম পানির জন্য ডাকা হয় নি তোমাকে,এখানে চুপচাপ দাঁড়াও।এই রুহি বাহিরে আয়,বাবা কোথায় বাবা একটু কষ্ট করে বাহিরে আসো তো।

কিছুক্ষণ পর সবাই বাহিরে আসলো।

নীলা আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই,মন দিয়ে শুনবে।এ বাড়ি থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে,আজকে আর এক্ষুনি।

মা আমার কথা শুনে মুচকি হেসে উঠলো।রুহিও তেমন কিছুই বললো না,তবে বাবা বললো,"কি বলছিস এসব,বউমা কোথায় যাবে?

-কোথায় আবার তাঁর বাবার বাড়ি।

মা তার আগে ওর কিছু হিসাব নিকাশ আছে,সেগুলো মিটিয়ে তারপর ওকে বার করে দিবো।

মা বললো,কি হিসাব বল খোকা?

আমাদের বিয়ে হয়েছে,দুইবছর সাতমাস,পনেরোদিন।আর নীলা এ বাড়িতে আসার পরদিন থেকে কোনো বুয়া আসে নি।
বুয়া যেহেতু আসেই নি,তাহলে বুয়ার কাজগুলো তো নীলায় করেছে এতদিন ধরে।
বুয়াকে দু বার খাওয়া সহ মাসে ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো,তাহলে ১,৮৬০০০ টাকা।আর বোনাস বাবদ আরো চোদ্দ হাজার হলে মোট দুইলাখ।
এই দুইলাখ টাকা নীলাকে দিয়ে বার করে দাও।

মা খানিকটা ভ্রু কুচকে বললো,"খোকা এতোগুলো টাকা ওকে দিবো কেন?আর ওকি বুয়া নাকি,যে বুয়ার বেতনের টাকা পাবে,ওতো এ বাড়ির বউ।

-তাই নাকি,এ বাড়ির বউ!বউয়ের মর্যাদা কখনো দিয়েছো তাকে?ছোট থেকেই দেখে আসছি বাড়িতে শিরিনা নামের একজন বুয়া কাজ করে এসেছে।আর যেইদিন বিয়ে করে নীলাকে নিয়ে আসলাম,সেইদিন থেকেই বুয়ার পেট খারাপ হলো,মেনে নিলাম পেট খারাপ হয়েছিলো,তাহলে দ্বিতীয় আর কোনো বুয়াকে কেন রাখা হলো না।বাড়ির বউ হয়ে সংসারের কাজ করতেই পারে,এটাও মেনে নিলাম।তাহলে রুহিও তো এ বাড়ির মেয়ে,কোই তাকে তো কোনোদিন কোনোকিছুতে হাত লাগাতে দেখলাম না।
মা আজকে রুহির দিকটা ভেবে একটু চিন্তা করো তো,যদি নীলার জায়গাতে রুহি আর তোমার জায়গাতে রুহির শাশুড়ি থাকতো,আর রুহির সাথে যদি এমনটা হতো,তাহলে তুমি বিষয়টা কিভাবে নিতে?

মা সংসারে যা কিছু হয়েছে সেগুলোতে কারোও হাত নেই,বা কারোর জন্যও হয় নি।
হয়তো নিয়তিতে ছিলো এমনটা।
আর নিয়তিকে বদলাতে আমি বউ বদলিয়ে ফেলবো?
নীলা এ বাড়ির কাউকেই চিনতো না,শুধু আমার উপর ভরসা করে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে,আর আজকে নিজেরা নিয়তির কাছে হেরে গিয়ে তার ভরসাকে ভাঙ্গতে পারবো না।
মা তোমাদের যদি নীলাকে নিয়ে এতোই সমস্যা হয়ে থাকে,তাহলে আমি নীলাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি,কারণ হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওর হাতটা ধরি নি আমি।

মা কে কিছু বলার আগেই নীলাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
মেয়েটা অঝোরে কাঁদছে,তবে কেন কাঁদছে তা জানার চেষ্টা করি নি আমি।
আজ দু বছর হয়ে গিয়েছে,নীলাকে নিয়ে দুই রুমের ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে আছি।
বেতনের টাকা দিয়ে কোনোরকমে চলে যাচ্ছে, আর হ্যা আমাদের টুনাটুনির সংসারে একটা ফুটফুটে টুনটুনিও এসে গেছে।ওর নাম আদ্রিতা।
বাবা মাঝেমধ্যে আসে,এসে আমার মেয়ের সাথে সময় কাটিয়ে আবার চলে যায়।
মা হয়তো এখনো অভিমান করে আছে,সমস্যা নেই।
যেই সন্তানের জন্য একদিন নীলাকে ডিভোর্স দিতে বলেছিলো, সেই আদ্রিতাই আর কিছুদিন পর গিয়ে আমাদের মা ছেলের অভিমানের পর্ব শেষ করে দিবে।

লেখাতে-আশিকুর রহমান

No comments:

Post a Comment

comment

Contact Us

Name

Email *

Message *