ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশি আনন্দ।

Thursday, July 14, 2022

ললিতা

ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প

 ললিতা মারা গেছে। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছে। ললিতা আমার স্বামীর পুরোনো প্রেমিকা। একদম বিছানা গরম করা প্রেমিকা। শুনতে খারাপ লাগলেও এই সত্যটা আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। বিষয়টি আমি জানতে পারি আমার গায়ে হলুদের রাতে।

রাত তখন আনুমানিক এগারোটা। আমার দুই হাত ভর্তি মেহেদি। একা ঘরে বসে আছি। মেহেদি শুকিয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়ব। যদিও আমার দুই চোখে ঘুম নেই। অচেনা একজন মানুষের বউ হয়ে যাব রাত পোহালে। এমতাবস্থায় কোনো বিয়ের কনে ঘুমাতে পারে কি-না আমার জানা নেই। আমার মোবাইল বেজে উঠল। এত রাতে কে ফোন দিবে! গ্রামে রাত এগারোটা মানে অনেক রাত। হবু বর আমার ফোন নাম্বার নিয়েছিল। তিনি ফোন দেননি তো?
ফোন রিসিভ করার জন্য আঙুল রয়েছে। কিন্তু কানে নিয়ে কথা বলতে গেলে মেহেদি লেপ্টে যেতে পারে। আমি ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকার অন করে হ্যালো বললাম। অপর প্রান্ত থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ এক নাগারে কথা বলছে।
"আমাকে আপনি চিনবেন না মিস লিজা। আপনাকে জরুরী খবর দিতে ফোন করেছি। নাম্বার কোথা থেকে জোগাড় করলাম, সেটা ভেবে দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার সাথে একটি মেয়ে দেখা করতে চায়। আগামীকাল সকাল দশটায় মাটির তিন রাস্তার মোড়ে আসলে মেয়েটিকে দেখতে পাবেন। মেয়েটি আপনাকে কিছু বলতে চায়।"
পুরুষ কণ্ঠের কথামালার শেষ প্রান্তে আমি ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য নিশ্চুপ। তারপর আমার প্রশ্ন, "আমি কেন ঐ মেয়েটির সাথে দেখা করব? আর দেখা করাটা কেন জরুরী?"
উত্তরে লোকটি বলল, "কারণ মেয়েটি আপনার হবু বরের প্রেমিকা ছিল।"
আমার বুকের ভেতরে কিঞ্চিত ধাক্কা খেলেও একগাল হেসে বললাম, "বিয়ের আগে একজন মানুষের প্রেমের সম্পর্ক থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।"
লোকটি অট্টহাসি দিয়ে বলল, "কিন্তু মেয়েটির সাথে আপনার হবু বরের একাধিকবার বিছানা ভাগাভাগি হয়েছে।"
আমি ফোন কেটে দিলাম। আর শুনতে চাই না কোনো কথা। পরপর আরো দু'বার ফোন আসলেও আমি রিসিভ করিনি। চক্ষু টলমল থাকতে না পেরে ঠেলে দুই ফোটা পানি বের করে দিলো। দাঁতে কিড়মিড় করে চোখের পানি মুছে ফেললাম। ভেজানো দরজা পা দিয়ে খুলে বাইরে উঁকি দিলাম। বাড়ির মানুষ এখনো ঘুমায়নি। মা মশলা বাটার তদারকি করছেন। বাবা দই পাতার জন্য বাবুর্চির সাথে কথা বলছে। হবু বরের নাম্বার বাবা-মা আর ভাইয়ের কাছে আছে। নাম্বার চাইতে লজ্জা করলেও গায়ে মাখলে চলবে না। মা'কে ডেকে জানতে চাইলাম ভাইয়া কোথায়!
মা বলল, ভাইয়ার বন্ধুদের ঘুমানোর জন্য ঘর দেখাতে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইয়ার দর্শন পেলাম। ডেকে এনে নির্লজ্জের মতো হবু বরের নাম্বার চাইলাম। ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফোন বের করে নাম্বার দিলো। আমি ঘরে এসে দরজা চাপিয়ে দিলাম। ফোন করলাম হবু বরকে।

উনার নাম শরীফ আহমেদ। আহমেদ'টা আগে নিয়ে আসলে বাংলা সিনেমার খলনায়ক। এখন উনাকে আমার নব্য জীবনে খলনায়ক মনে হচ্ছে। ফোন রিসিভ করার পর সালাম দিলাম। উনি সালামের জবাব নিয়ে বলল, "আমি মাত্রই ফোন দিতে চেয়েছিলাম। তোমার নাম্বার সেভ করে রেখেছি।"
আমি সরাসরি বললাম, "আপনি কারো সাথে প্রেম করতেন?"
উনি আমতা আমতা করে বলল, "হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন লিজা?"
-কেন? আমি কি প্রশ্ন করতে পারি না?
-হ্যাঁ, অবশ্যই পারো। কিন্তু...
-আমি কিন্তু শুনতে চাইনি। হ্যাঁ বা না শুনতে চেয়েছি।
-হ্যাঁ। প্রেম করেছিলাম। কিন্তু এখন কোনো সম্পর্ক নেই।
-শারীরিক সম্পর্ক করেছেন?
অপরপ্রান্তে পিনপতন নীরবতা। যেন মুখের জবান আমি কেড়ে নিয়েছি। আমি শান্ত ও মোলায়েম কণ্ঠে বললাম, "আগামীকাল আমার আর আপনার নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। আমি চাই না আমাদের সম্পর্কটা মিথ্যে দিয়ে শুরু হোক। তাই আমি চাই সত্যিটা জানতে।"
উত্তরে উনি বললেন, "আসলে লিজা আমাদের শারীরিক সম্পর্কটা দুর্ঘটনা ছিল। আমরা আগে থেকে..."
পরের কথাগুলো আমি আর শুনতে পাইনি। মোবাইল কান থেকে নামিয়ে টেবিলে রেখে দিলাম। হাতের আঙুলের মেহেদি লেপ্টে গেছে মোবাইল কানে ধরে রাখার সময়। যেন দুঃখকে লেপ্টে দিলাম জীবনের সাথে।

গায়ে হলুদের রাতে বিয়ে বন্ধ করার মতো ক্ষমতা আমার হাতে ছিল না। শরীফ আহমেদ যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিল, সেদিন চেয়েছিলাম যেন বিয়েটা এখানে না হয়। বাবার অনেক সম্পত্তি আছে বলে ছেলে কিছু করবে না। শুধু ঘুরবে আর খাবে। ভবিষ্যতে কিছু একটা করবে। এসব শুনে লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি। ভবিষ্যতে কিছু একটা করলে এখন থেকে কেন শুরু করছে না?
কিন্তু আমার এই যুক্তি বাবা-মা, ভাই কিংবা আমার চাচারা কেউ আমলে নেয়নি। তারা ছেলে চিনতে ভুল করেনি। ভালো বংশ, সুখে থাকব, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মতামতের আর দাম রইলো না। আরেকবার অন্য এক পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। সবেমাত্র ইন্টার পাশ করা কিশোরী ছিলাম তখন। আমি জানতাম না আমাকে দেখতে এসেছে। ভাইয়ের সাথে ছেলেটি এসেছিল শুধু। যখন জানতে পারি আমাকে দেখতে এসেছে, আমি ছেলেটির সামনেই হেসে ফেলি। ছেলেটি ফিরে গিয়ে ভাইয়াকে বলেছিল, "তোমার বোনের নিশ্চয় সম্পর্ক আছে। তাই এমনটা করল।" ভাইয়া সেদিন বাড়ি এসে মেরেছিল আমাকে।
হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার বাবা; আমাকে খুব আদর করতেন। আমার বিয়েতে বাবার আগ্রহ ও ইচ্ছে দেখে হাসি মুখে আগুনে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করবে। ফলাফল, বিয়েটা আমাকে করতে হলো। বিয়েরদিন সকালে আমি আর মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাইনি। যেখানে বর সবকিছু স্বীকার করেছে, সেখানে মেয়েটা নাহয় আরো দুই লাইন বাড়িয়ে বলবে! ঐ দুই লাইন আমি আর শুনতে চাইনি। মানুষ সম্পর্কে যত কম জানা যায়, ততোই ভালো।

একাধিকবার আমার বর আমার কাছে ললিতা সম্পর্কে বলতে চেয়েছে। আমি শুনতে চাইনি। আমি জানি, ললিতার কথা শুনলে আমার খারাপ লাগবে। গা গিনগিন করবে। তবুও অগনিত বার আমার বর সেই কথা বলতে চেয়েছে। যেন বলতে না পারার কষ্ট তাকে কুড়ে খাচ্ছিলো। তাই একদিন তার মনে জেদ চাপল। আমার কাছে সে না বলে শান্তি পাচ্ছে না। বাইরে সেদিন টিপটিপ বৃষ্টি। সাথে মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়া। জানালা বন্ধ করা হয়নি। দিনের আলো নিভে এসেছে। একেকবার বিদ্যুৎ চমকে বাইরের অন্ধকারকে বিদায় জানানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। দিনের আলো হয়তো অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু মনের ভেতরকার অন্ধকারকে ঠেলে দেওয়ার মতো আলো কি আছে পৃথিবীতে?
বর সেদিন জেদ নিয়ে বলল, "লিজা, আজ তোমাকে শুনতেই হবে। নয়তো আমি শান্তি পাচ্ছি না।"
আমার অনিচ্ছায় সে তখন বলল, "লিজা আমি ললিতাকে ভালোবাসতাম, এটা সত্যি। কিন্তু ললিতা ভুল মানুষ ছিল। সে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। কখনো না, কোনোদিন না।"
মুখ ফসকে সেদিন বলেছিলাম, "ভালো না বাসলে বিছানা অবধি চলে গেল মেয়েটা?"
অসহায় চাহনিতে বর বলল, "এই কথাটাই তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে। ললিতা একাধিক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর এতেই সে সুখ পেত। ললিতা ছিল অন্য ধর্মের। বাড়ি পাশের গ্রামে। একজন প্রেমিকের সাথে সে বেশিদিন থাকত না। একজন ছেলের সাথে কিছুদিন প্রেম করত। কিছুদিন ঘুরাঘুরি করত। বিছানায় যাওয়ার পরিস্থিতী সৃষ্টি করত সে নিজেই। তুমি হয়তো বলবে, মেয়ে হয়ে সে এমনটা কেন করবে? কিন্তু কিছু মানুষকি অদ্ভুত থাকে না? তার প্রেম-ভালোবাসা সেই পর্যন্তই। সে নতুন প্রেমিকের সন্ধানে ঘুরত। আমার সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরও চার পাঁচজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে ললিতা। পরে শুনেছি, সে একটি ছেলের কাছ থেকে ধোকা খেয়েছিল। সেই থেকে সেও ধোকা দেওয়া শুরু করেছে। তবুও বিছানা ভাগাভাগিতে আমি ললিতার দোষ দেই না। কারণ একই দোষ আমিও করেছি।"
আমি বরকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, "আর শুনতে ইচ্ছে করছে না। খুব মাথা ব্যথা করছে।"
ললিতার গল্প শোনা আমার সে পর্যন্তই। কিন্তু ললিতা নিজে আমাকে ফোন করেছে কয়েকদিন। ফোন করে জানতে চাইতো, "কেমন আছো লিজা? তোমাদের সংসার কেমন চলছে? তোমার বর কি তোমাকে ভালোবাসে? না-কি এখনো আমার বিরহে মন খারাপ করে আনমনা থাকে?"
আমি নিজেকে সামলে জবাব দেই, "আমাকে সে অনেক ভালোবাসে। আমরা অনেক সুখে আছি।"
শেষবার ফোন করেছিল চার বছর আগে। ফোন করে বলল, "লিজা, তোমার বর আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে। সেটা জানার পরও তোমার খারাপ লাগে না? কষ্ট লাগে না?"
উত্তরে আমি বলেছি, "না, খারাপ লাগে না। কিন্তু তুমি যে ফোন করে আমার স্বামীর কথা মুখে উচ্চারণ করো, এটা শুনতে খারাপ লাগে। মোটকথা তুমি ফোন করলেই আমার খারাপ লাগা শুরু হয়।"
সেই থেকে বিগত চার বছরে ললিতা আমাকে আর ফোন করেনি।

তখন আমি প্রথমবার গর্ভবতী। বর বিছানায় আমার পাশে বসা। অদ্ভুত এক সত্য হলো, তখন পর্যন্ত দিনের আলোতে বরকে খালি গায়ে দেখিনি আমি। টি-শার্ট বা শার্ট পরে থাকত। তাছাড়া তার সুরসুরি বেশি। তার গায়ে হাত পড়লেই যেন লাফিয়ে উঠে। আমার সামনে খালি গায়ে আসতে মনে হয় নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পায়। আমি এই নিয়ে বরকে কখনো কথা শুনাইনি। কিন্তু সেদিন হঠাৎ বলল, "লিজা দেখো তো। গলার নিচে বুকের উপরে কী একটা হইছে। শুধু চুলকায়।"
শার্টের বোতাম খুলে দিলো। ছোট্ট এক ব্রণের মতো। লাল হয়ে আছে। এর একটু নিচেই ইংরেজী বড়ো হাতে 'এল' অক্ষরটি লেখা। তখনকার সময়ে কিশোর-কিশোরী এক ধরণের পাতা ছিলে নাম লিখে পাতাটি লাগিয়ে রাখত। চামড়া পুড়ে অক্ষরটি স্থায়ী হয়ে যেত। অনেকে এসিড পাতা বলত। বরের বুকে ললিতার নামের প্রথম অক্ষরটি দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি আর সেই সম্পর্কে বরকে কিছু না বললেও মনে পড়লে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথার জন্ম হয়। যে বুকে আমি মাথা রাখি, সে বুকে অন্য একটি মেয়ের নামের অক্ষর লেখা। কষ্টটা খুব তীক্ষ্ণ আর গভীর। আমি বরকে সেই ব্যথা বুঝতে দিতে চাইনি কখনো। জেমসের গাওয়া গানের একটি লাইন ধারণ করেছি মনে। "এই ব্যথা আমারই থাক, চাই না কারো সান্ত্বনা।"

আমার গায়ে হলুদে যে লোকটি ফোন করেছিল। আজও সেই লোকটি ফোন করে ললিতার মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে। লোকটির পরিচয় আমার জানা নেই। অথবা লোকটির সাথে ললিতার সম্পর্কও জানি না। তবুও দুইদিন দুইবার ফোন করে লোকটি দু'টি সংবাদ প্রেরণ করেছে আমার কাছে।
কেন জানি না, ললিতার আত্ম হননের সংবাদ পেয়ে আমার কষ্ট লাগছে। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। বর আমাদের আদরের মেয়েটাকে ছাতা মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরল। বর তোয়ালে দিয়ে মেয়ের মাথা মুছে দিচ্ছে। বাবা মেয়ের মাঝখানে আমি যাইনি। একটু দূর থেকে ভাবছি, ললিতার মৃত্যু সংবাদ কি বরকে দেব? না-কি অনেক কিছু বুকের ভেতর চেপে রাখার মতো এই সংবাদটিও চেপে রাখব!
গ্রীলে একটি চড়ুই পাখি এসে বসেছে। গা ঝাড়া দিচ্ছে আর অনবরত ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু পাখিটির ডাক শোনার জন্য অন্য কোনো পাখি নেই এখন। অন্য সময় অনেক পাখির ভীড়ে থাকলেও চড়ুইটি এখন কত একা, নিঃসঙ্গ। মনুষ্য জাতীও বছরের পর বছর মানুষের ভীড়ে থেকেও কখনো কখনো সে খুব একা ও নিঃসঙ্গ থাকে।

সমাপ্ত..


লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,
,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ

No comments:

Post a Comment

comment

Contact Us

Name

Email *

Message *