ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশি আনন্দ।

Friday, December 14, 2018

অনন্ত ভালবাসা

love story, valobashar golpo, ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প,
মেয়েটার নাম মিনু। বয়স ২৫। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে চার চারবার সে ফিরে এসেছে।এই ভয়ঙ্কর সময়গুলোর প্রতিটাক্ষন মিনুর পাশে যে থেকেছে , সে মিনুর স্বামী , সাইদুল। আসুন মিনুর গল্পটা শুনি।

এক বছর আগে প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মিনুর দুর্বিষহ জীবনের সুত্রপাত। কুষ্টিয়ার কোনো এক প্রাইভেট হাসপাতালে মিনুর সিজার হয়।ঘর আলো করে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক ছেলে শিশু। খুশির আমেজ মিইয়ে যেতে সময় লাগলো না । অপারেশানের দুই দিন পর মিনুর পেট ফুলতে থাকে।ক্লিনিক কতৃপক্ষ গা বাচাতে দ্রুত মিনুকে সদর হাসপাতালে রেফার করে। প্রথম অপারেশানের মাত্র ৪ দিনের মধ্যে সদর হাসপাতালে দ্বিতীয়বার সার্জনের ছুরি কাচির নীচে যেতে হয় মিনুকে। পেট কেটে দেখা যায় তার পুরো পেটজুড়ে পায়খানা ছড়িয়ে আছে। small intestine(ক্ষুদ্রান্ত্র)এর দুই তিন জায়গায় ফুটো খুজে পাওয়া যায়। সার্জনরা খুঁজে পাওয়া ফুটো গুলো রিপেয়ার করে আসেন।তারা ধারনা করে সিজার অপারেশানের সময় এই ইনজুরি গুলো হয়েছিলো। সাইদুল আশায় থাকে , মিনু এবার ভালো হবে। বাসায় তার দুধের বাচ্চা।

কুস্টিয়া সদর হাসপাতালে দ্বিতীয়বার অপারেশানের পরেও মিনুর অবস্থার উন্নতি হল না । ড্রেইন টিউব দিয়ে এখনো পায়খানা আসছে। চিকিৎসকরা জরুরী ভিত্তিতে মিনুকে রেফার করলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেলে ইমারজেন্সি ওটিতে তৃতীয় বারের মত মিনুর অপারেশান শুরু হল।পেট খুলে দেখা গেলো huge gut adhesion। কোনটা small gut কোনটা large gut কিছুই আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিলো না।এই অবস্থায় বেশি ঘাটাঘাটি করলে আরো ইনজুরি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। সার্জন তাই সবচেয়ে মোবাইল অংশটি পেট দিয়ে বের করে পায়খানার রাস্তা করে দিলো।আপাতত এভাবেই মিনুর পেটের ভিতর পায়খানা জমা যাতে না হয় তার একটা টেম্পরারি সমাধান করা গেলো। এই অপারেশানের পর মিনু প্রায় ১ মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। এর ভিতর তার ক্ষতস্তানে ইনফেকশান হয় , যার ফলশ্রুতি তে নাড়ি পেট ফেটে বের হবার উপক্রম হয়। Tension sutur দিয়ে পেট ফাটার চিকিৎসা করা হল। এতোগুলো অপারেশানের চাপ আর শরীর থেকে বেশি পরিমান তরল বের হয়ে যাওয়ার দরুন মিনুর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পরে।, ক্ষত শুকাতে দেরি হয়। শিরাতে স্যালাইন এবং বিভিন্ন পুস্টিকর উপাদান দিয়ে(TPN) তার স্বাস্থ্যর উন্নতি করার চেস্টা চলে। এই সব অতিরিক্ত খরচ মেটাতে সাইদুলের নাভিশ্বাস উঠে যায়, কিন্তু স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে সে কখনই কার্পন্য করেনি। ১ মাস পর পেটে পায়খানার রাস্তা নিয়ে মিনু বাড়ি যায়। ৩ মাস পর তাকে আমারা পুনোরায় অপারেশানের জন্যে আসতে বলি। তখন তার পায়খানার রাস্তাটি আবার পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হবে এবং আবার সে স্বাভাবিক মানুষের জীবন যাপন করতে পারবে।

৩ মাস পর সাইদুল মিনুকে নিয়ে আমাদের ওয়ার্ডে(২১৭) ভর্তি হয়। মিনুর মুখে হাসি ফিরে এসেছে।এখন সেই হাসি পুর্নতা পাবার অপেক্ষায়। অপারেশান হল। পায়খানার রাস্তা পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হল।মিনু এখন সম্পুর্ন সুস্থ।
মিনুর গল্প শুনলাম এবার সাইদুলের গল্প শুনি । সাইদুল একজন ফেরিওয়ালা।মিনুর সাথে বিয়ে হয়েছে তিন বছর হতে চলল। সে কুস্টিয়া থেকে লুঙ্গি কিনে চট্রগ্রামে ফেরি করে বিক্রি করে। কুস্টিয়ার লুঙ্গির চট্রগ্রামে বেশ কদর। গত প্রায় এক বছর যাবাত স্ত্রীর এরুপ অসুস্থতায় তার ব্যাবসার অবস্থা ভালো যাওয়ার কথা না। ওষুধ কিনে আনা ছাড়া প্রতিটা সময় সে স্ত্রী মিনুর পাশে আঠার মত লেগে ছিলো। স্ত্রীকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে ঘন্টায় ঘন্টায় মিনুর প্রস্রাব পায়খানা পরিস্কার করা ছিলো সাইদুলেরে প্রাত্যহিক কাজ। স্ত্রীর বেড এর নীচে গুটিশুটি পকিয়ে, মশার কামড় খেয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হত তাকে। মিনুর একটু টু শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যেতো। ব্যাথায় মিনুর কান্না না থামলে হাত ধরে সান্তনা দিতো আবার ডাক্তার আসলে লজ্জা পেয়ে হাত সরিয়ে নিতো।বাড়ি যাবার পর একবার মিনুর stoma bag( পায়খানা জমা হওয়ার ব্যাগ) খুলে গেলো । সাইদুল তখন চিটাগাং । খবর পেয়ে চিটাগাং থেকে সে কুষ্টিয়া গেলো । মিনুকে নিয়ে এলো ডি এম সি তে শুধু stoma bag লাগানোর জন্যে।

একবার কাধে আস্তো এক বস্তা ঝুলিয়ে ২১৭ নম্বর ওয়ার্ডে এলো সাইদুল । বস্তা খুলে দেখা যায় সেখানে রয়েছে লাউ, পালং শাক, চাউলের গুরা, দেশি মুড়ি,চিড়া, মিস্টি। এতো দূর থেকে এগুলো সে ডাক্তারদের জন্যে বয়ে নিয়ে এসেছে। অথচ তখনো পর্যন্ত তার স্ত্রী সম্পুর্ন সুস্থই হয়নি। এতোকিছু আনাতে স্যার তাকে কড়া করে বকা দিলেন। বকা শুনে লজ্জিত সাইদুলের মাথা নীচু করে রইলো । বিদায় নেবার আগে আমাদের বলে গেলো- “স্যার আমার বউ এখন অনেক ভালো আছে । বাচ্চাটরে মায়ের কোলে ফিরাইয়া দিছেন । বাড়ির সবাই ধরে নিছিলো মিনু মারা যাবে, সেখান থেকে আপনারা ওরে ফিরাইয়া আনছেন ।আমার পোলাটা এতিম হয় নাই। আপনাদের উসিলায় আমার বউটারে আল্লাহ আবার নতুন জীবন দিছে ।আবার আলোর মুখ দেখাইছে। আমি গরীব মানুষ, ইচ্ছে করে আপনাদের জন্যে অনেক কিছু করি। কিন্তু আল্লাহ সেই তৌফিক আমারে দেন নাই”।

অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থেকে পরম মমতার দিয়ে তার সেবা করে সাইদুল যে নজির স্থাপন করেছে তা এই জামানায় বিরল। এই যুগের প্রেম ভালোবাসা ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ ।নীল দেয়াল এর বাইরে এরা বড় ফ্যাকাশে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আগে এই ছবিটা তোলা হয়। ছবিটা দেখে মিনু মুখ কালো করে বলে “হাইরে আমি দেখতে কি বিশ্রি হইয়া গেছি” ।
মিনু ,তুমি যতই বিশ্রি হও্না কেনো, সাদা মনের সাইদুলের অন্তরের সৌন্দর্যে আলোকিত রাজপ্রসাদে তুমিই রাজরানী । যেখানে রানীর জন্যে থাকবে “অনব ভালোবাসা” ।

তানভীর শুভ(copied)

No comments:

Post a Comment

comment

Contact Us

Name

Email *

Message *