শীতের ছুটিতে আমরা খালার বাড়িতে যাই প্রতি বছর। এবারও গিয়েছি, তবে এবারের যাওয়া যেন অন্যরকম ছিল। কারণ এবার ওখানে ছিল মাইশা—আমার খালাতো বোন। আগেও দেখেছি তাকে, কিন্তু এইবার যেন মেয়েটাকে নতুন করে দেখলাম।
মাইশা এখন কলেজে পড়ে। চুল বড় হয়ে গেছে, চোখে একটা অদ্ভুত টান, আর হাসিটা আগের চেয়েও বেশি প্রাণখোলা। আর ওর ঠোঁটের ডানপাশে ছোট্ট একটা তিল, যেটা হাসলে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে—অজান্তেই মন চুরি করে।
আমরা সবাই দুপুরে গল্প করছিলাম, হঠাৎ মাইশা আমার দিকে চেয়ে বলল,
– “তুই এখন অনেকটা বদলে গেছিস রাফি। আগের মতন কাঁচা পাকা ছেলেটা নেই।”
আমি একটু হেসে বললাম,
– “তুইও তো আগের মাইশা না... একদম সিরিয়াস লাগছে এখন।”
সে চোখ সরিয়ে বলল,
– “সবাই বড় হয়ে যায়... কিন্তু কেউ কেউ মনে থেকে যায়। তুইও থাকিস কি?”
ওর কথাটা এতটাই নরম ছিল যে মনে হচ্ছিল শব্দ নয়, যেন স্পর্শ।
🌙 রাতের বেলা
আমি ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে মাইশার কণ্ঠ...
– “চাঁদ দেখিস? নাকি কারো কথা ভাবিস?”
আমি চমকে উঠে বললাম,
– “তুই সবসময় এমন ঢুকে পড়িস কেন?”
সে হেসে বলল,
– “যার ভাবনায় আছি, তার মনে ঢুকে না পড়লে আর কবে পড়ব?”
আমি থমকে গেলাম।
– “তুই বুঝে বলছিস, নাকি…”
সে আস্তে এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়াল,
– “তুই ভাবলি বলেই তো বললাম… আমরা কি শুধু খালাতো ভাই-বোনই থাকতে পারি?”
আমি আর কিছু বলিনি। কিন্তু মনে হচ্ছিল, ছাদের বাতাস থেমে গেছে, আর চাঁদের আলো আরও সাদা হয়ে উঠেছে।
২.
ছুটির দিনগুলো খুব দ্রুত চলে যায়, বিশেষ করে যখন কারো প্রতি মন ধীরে ধীরে বাঁধা পড়ে।
সকালটা ছিল খুব হালকা রোদ্দুরে ভেজা, আর উঠোনে বসে সবাই পিঠা বানাচ্ছিল। আমি অলসভাবে বারান্দায় বসে ছিলাম।
হঠাৎ, মাইশা পাশে এসে বসল। হাতে এক প্লেট চিতই পিঠা আর নারকেলের ভর্তা।
– “এই নে, নিজ হাতে করেছি,” ওর কণ্ঠে ছিল একরকম মৃদু আহ্বান।
আমি একটু ঠাট্টার ছলে বললাম,
– “পিঠা খেতে এলি, না মনটা দিতে?”
সে চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল,
– “মন দিলে, খাবি?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
– “শুধু খাবো না… রেখে দেবো, যত্ন করে।”
ও কিছু না বলে প্লেটটা আমার পাশে রেখে উঠে গেল, কিন্তু ওর চোখ… ওটা একবার তাকিয়ে গেল আমার দিকে, যেন অদৃশ্য কিছু বলল।
🌧️ বিকেলের বৃষ্টি
বিকেলে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সবাই ব্যস্ত, আর আমি ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম।
একটু পরেই মাইশাও এসে দাঁড়াল আমার পাশে—একটা পুরনো ছাতা নিয়ে।
– “সবসময় এমন একা একা কেন থাকিস?”
আমি বললাম,
– “যখন তুই আসিস, তখন আর একা থাকি না।”
হঠাৎ মাইশা আমার হাতটা ধরল। খুব আস্তে, কিন্তু সেই স্পর্শটা যেন শরীর নয়, হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
ও বলল,
– “সব মেলামেশার নাম প্রেম না, কিন্তু সব প্রেমেই একটা ছোঁয়ার অপেক্ষা থাকে।”
আমার গলার স্বর কাঁপল।
– “তুই জানিস এটা ঠিক নয়… তাও?”
মাইশা হাসল।
– “ভুল আর ঠিক… এগুলো কাগজে লেখা যায়, অনুভবে নয়।”
তারপর হঠাৎ—আমার বুকে মাথা রাখল। বৃষ্টির শব্দের নিচে, আমরা দুজন একসাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোনো কথা ছিল না, শুধু ভেজা আবেগ।
রাত প্রায় ১২টা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। নিস্তব্ধতার মধ্যে একমাত্র শব্দ—ঘড়ির কাঁটা আর দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ডাক।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ ফিসফিস করে কেউ ডাকল…
– “রাফি…”
চমকে তাকালাম। মাইশা।
পায়ের আওয়াজ না দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে এল আমার পাশে।
– “তুই এখনো জেগে আছিস বুঝে এসেছি,” মুচকি হাসি ওর ঠোঁটে।
আমি বললাম,
– “তোকে দেখলে ঘুম আসে না মাইশা…”
ও চুপ করে আমার চোখে তাকিয়ে রইল। চারপাশে কুয়াশার মতো নীরবতা।
– “আজ কিছু চাই রাফি… শুধু আমার জন্য।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
– “কি?”
ও একটু এগিয়ে এলো। আমার বুকের খুব কাছে।
– “একটা রাত… শুধু আমাদের। যেখানে আমরা ভাই-বোন না, আত্মীয় না… শুধু আমি মাইশা, আর তুই রাফি।”
আমার গলা শুকিয়ে গেল। ঠোঁটটা একটু কেঁপে উঠল।
– “তুই জানিস এটা ঠিক নয়…”
ও আমার হাতটা ধরল এবার।
– “ঠিক না জানি, তাও তোকে ছুঁতে ইচ্ছে করে। তোর গলায় মুখ রাখার ইচ্ছে করে… তোকে চুপচাপ জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।”
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ধীরে ধীরে ওর হাত ধরে কাছে টানলাম। ওর কপালে চুমু খেলাম। তারপর গলায় মুখ রাখল ও, আমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম।
আমরা দুইজন একে অপরকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু সময়—নিঃশব্দে, নিঃশ্বাসে, আর গভীরতায়।
হঠাৎ দূর থেকে একটা দরজা খোলার শব্দ।
মাইশা তাড়াতাড়ি সরে গেল।
– “এই মুহূর্তটা রাখলাম হৃদয়ে… যদি আর কোনোদিন এমন না হয়।”
আমি বললাম,
– “হবে… যদি তুই চাস।”
সে একবার তাকাল, তারপর হেঁটে চলে গেল। পেছনে রেখে গেল শরীরজুড়ে জড়িয়ে থাকা একটা ঘোর আর মনে জমে থাকা এক অন্যরকম ভালোবাসা।
৪.
সকালটা অস্বাভাবিক নীরবতায় ভরা ছিল।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাইশা নিচতলার বারান্দায় বসে ছিল। আমি এসে দাঁড়ালাম পাশে। কেউ কিছু বলছিল না, কিন্তু মনে মনে—গতরাতের প্রতিটা মুহূর্ত যেন বারবার ফিরে আসছিল।
আমি আস্তে বললাম,
– “তুই ঠিক আছিস?”
ও চায়ের কাপটায় চোখ রেখে বলল,
– “না… আমি ভয় পাচ্ছি, রাফি।”
– “আমিও। কিন্তু তোকে ছাড়া থাকাটা আমার আর সম্ভব না।”
ওর চোখ দুটো ফেটে পড়তে চাইছিল, কিন্তু নিজেকে ধরে রাখল।
– “ভালোবাসি তোকে… কিন্তু আমাদের এই সম্পর্ক কোনোদিন আলোর সামনে দাঁড়াতে পারবে না।”
– “তাহলে কি করব আমরা?”
সে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে বলল,
– “চলে যাবি?”
আমি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে ভেসে এল খালার গলা,
– “মাইশা! এখানে বসে আছো কেন? ও রাফি, তুইও তো কোথাও বের হলি না আজ?”
মাইশা হাসি মুখে উঠে গেল। কিন্তু সেই চোখের জল আমি স্পষ্ট দেখলাম।
🌆 সেদিন বিকেলে
আমি ব্যাগ গোছাচ্ছি। সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার।
মাইশা এসে চুপচাপ দাঁড়াল।
– “এভাবে যাচ্ছিস?”
– “তুই চাইছিস না আমি থাকি…”
– “চাচ্ছি। কিন্তু তোর থেকে যদি দূরে না থাকি, তাহলে নিজেকে হারিয়ে ফেলব।”
আমি কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলাম।
– “তুই যদি বলিস, আমি এক্ষুনি তোকে নিয়ে চলে যেতে পারি।”
মাইশা চমকে তাকাল।
– “রাফি… তুই কি সত্যি?”
আমি চোখে চোখ রাখলাম।
– “ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তাহলে পালানোটা ভুল নয়।”
ও কিছু বলল না। শুধু আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। ছোট্ট একটা চুমু। কিন্তু তার গভীরতা যেন সারাজীবনের অনুভব।
No comments:
Post a Comment
comment