রাই ছিল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে, নতুন পরিবেশ, নতুন মুখ—সবকিছুতেই একটু দ্বিধাগ্রস্ত। ইংরেজি আর অঙ্কে একটু দুর্বলতা ছিল বরাবরই। তাই মা সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাইভেট টিচার রাখার। পরিচিত একজনের মাধ্যমে আলাপ হলো তানভীর স্যারের সাথে। সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন, পড়ানোটাই এখন প্যাশন।
প্রথম দিনই রাই বুঝে গেল, তানভীর স্যার একটু অন্যরকম। ক্লাসে যেমন শিক্ষকরা কড়া হতেন, উনি তেমন ছিলেন না। ধৈর্য ধরে বোঝাতেন, মাঝে মাঝে হালকা মজাও করতেন যাতে পড়াশোনাটা ভারী না লাগে।
রোজ বিকেলে স্যার আসতেন। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ছিল পুরোপুরি পড়াশোনা ঘিরেই। কিন্তু ধীরে ধীরে খেয়াল করল রাই, তানভীর স্যার মাঝে মাঝে তার মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। একদিন স্যার হেসে বললেন,
— "তোমার চোখে কিছু প্রশ্ন থাকে, যেগুলোর উত্তর বইয়ে পাওয়া যায় না।"
রাই একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। স্যারের দৃষ্টি যেন কিছু বলছিল, কিন্তু সে তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। সময়ের সাথে সাথে তারা হাসির মাঝে গল্প জুড়তে শুরু করল, পড়ার ফাঁকে জীবনের কথা, স্বপ্নের কথা, ভয়ের কথা উঠে এল।
একদিন বৃষ্টি নামল পড়ার সময়। স্যার আসতে দেরি করলেন। ভিজে গিয়েছিলেন অনেকটা। রাই দৌড়ে গিয়ে টাওয়েল দিল, গরম চা বানিয়ে আনল। সেই সন্ধ্যায় আর পড়া হয়নি। শুধু জানলার পাশে বসে, চা হাতে গল্প হল। রাই প্রথমবার স্যারের চোখে দেখল অন্যরকম কিছু। সেটা কি ভালবাসা? না কি কেবল কৃতজ্ঞতা?
স্যার হঠাৎ বললেন,
— "তুমি জানো, পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝে ভুলে যাই, তুমি আমার ছাত্রী। মনে হয়, আমি কারো এমন সঙ্গ পেয়েছি, যে শুধু শেখে না, শেখায়ও… ভালোবাসতে শেখায়।"
রাই চুপ করে ছিল। কিন্তু তার হৃদয়ে তখন ঝড় বইছে।
কিন্তু সমাজ তো সহজে মেনে নেয় না এসব। ছাত্রী আর টিচারের প্রেম? চারদিকে কথার ঝড় উঠল, মা প্রথমে জানতে পেরে ভয়ানক রেগে গেলেন। রাই কেঁদে ফেলেছিল, তানভীর স্যার তখনও চুপ। তিনি বললেন,
— "রাই, আমি চাই না তুমি কোনো সিদ্ধান্ত চাপে পড়ে নাও। আমি অপেক্ষা করব, যতদিন দরকার, যতক্ষণ তুমি নিজে বুঝে না বলো যে তুমি প্রস্তুত।"
রাই প্রথমবার বুঝল, এটা কোনো হঠাৎ মোহ নয়। এটা সম্মান, ধৈর্য, আর ভালোবাসার মিশ্রণ।
দুই বছর পর রাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। একদিন বিকেলে, সেই পুরনো টিচারকে সে নিজের হাতে লেখা একটা চিঠি দিল।
লিখেছিল—
"স্যার নয়, এখন আপনি তানভীর। আর আমি শুধু ছাত্রী নই। আমি রাই, যে আপনার পাশে হাঁটতে চায়, সারাজীবন।"
তানভীর চুপচাপ তাকিয়ে ছিল তার দিকে। তারপর ধীরে করে বলেছিল,
— "এই চোখে চোখ রাখা, অনেক বছর আগেই শুরু হয়েছিল। আজ থেকে এটা হৃদয় ছোঁয়ার গল্প হবে।"
No comments:
Post a Comment
comment